সন্ন্যাসীনী ধর্ষণ মর্মান্তিক না। বয়সটাও মর্মান্তিক না। মর্মান্তিক সমাজের অবক্ষয়টা। শরীরে ক্যান্সার হলে তার অনেক লক্ষণ ফুটে ওঠে। যেগুলো কদর্য, অসহনীয় হলেও মূল তো তারা নয়!
আমরা যে রোগটার শিকার সেটা হল- একটা মূল্যবোধহীন, অন্তঃসারশূন্য, ভণ্ড ব্যবস্থায় পরিপূর্ণ একটা সমাজের পোষ্য আমরা। কোনো বড় অপরাধই হঠাৎ করে ঘটে যায় না। বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পৈশাচিক ঘটনা যখন 'তুচ্ছ' ঘটনার আড়ালে যেতে শুরু করে তখন ধীরে ধীরে তারাই বড় ঘটনার আকার ধারণ করে। অন্তত সাহসটা পায়। চোখে ঠুলি পরে, কানে তুলো গুঁজে সংসারে যে নিরবিচ্ছিন্ন শান্তি অনুভব করা যায়, তাতেই অভ্যস্ত আমরা। হঠাৎ করে যখন আগুনের তাপ গায়ে ঠেকে, তাকিয়ে দেখি দাউ দাউ করে জ্বলছে চারিদিক, তখন হায় হায় করে ওঠার কি অর্থ! আগুন তো এক মুহুর্তে লাগেনি! ধীরে ধীরে যখন আগুন লাগার দাহ্য পদার্থগুলো জমা হচ্ছিল তখন কি করছিলাম? আজ চীৎকার করে পাড়া মাতালেই সমাধান হয়ে যাবে? কক্ষণো না। আমি সচেতন না হলে যেমন আমার বাড়ির, আমার সংসারের ঠিক-বেঠিক খেয়াল রাখা যাবে না, ঠিক তেমনই আমরা সচেতন না হলে কোনো দোহাই দিয়ে, কোনো আস্ফালনেই এর আশু সমাধান নেই।
আরেকটা কথা। আমার মনে হয় এই 'ধর্ষণ' সংজ্ঞাটাও এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বানানো একটা ভণ্ড তকমা বিশেষ। কেন 'ধর্ষণ' শব্দ? তার বীর্য গ্রহনের স্থান আছে বলে? তার শরীরে পেশির পরিমাণ কম বলে? সে সম্ভোগের সময় নীচে থাকে বলে? তার অর্থনৈতিক জোর নেই বলে? তাকে তোমার সংসারের পোষ্য ভোগ্য বানিয়ে রেখেছ বলে? সে অবলা, দেবী, শুদ্ধতার প্রতিমূর্তি, সহনশীলতার পরাকাষ্ঠা, আরো কত কি তকমা লাগিয়ে মেয়েদের যে স্থানে রাখা হয়েছে তা নিতান্তই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রত্যক্ষ আর পরোক্ষভাবে নিজেদের সুবিধার জন্যই। এটা আজ স্পষ্ট হওয়া দরকার।
'শারীরিক অত্যাচার' বলা যাক, 'ধর্ষণ' না। এই শব্দটার সাথে মিথ্যা কিছু একটা আছে। যা মানসিক। একটা কৃত্রিম লজ্জার বোধ তৈরী করে শারীরিক অত্যাচারকে, আত্মগ্লানিতে নিয়ে যাওয়ার কৌশল। ধর্ষনে একজনের কেন শুদ্ধতা নষ্ট হল, শ্লীলতাহানি হল? কেন শুদ্ধতা আর শ্লীলতা শুধু মেয়েদের বেলায় হবে? পুরুষের বেলায় প্রযোজ্য হয় না কেন? কারণ ওই যে বিয়ের আগে আমার অক্ষত যোনি মেয়ে খুঁজতে হবে। পুরুষ ভারজিন কি না- প্রশ্ন নয় কেন? এই মানসিকতা থেকেই এই 'ধর্ষণ' নামক নোংরা, ভণ্ড শব্দটার উৎপত্তি।
মেয়েরা যতদিন না বুঝছেন, এই শুদ্ধতার মোহ যতদিন না কাটছে ততদিন এ জিনিস চলতেই থাকবে। ততদিন 'লজ্জা' শব্দটা তাকে তাড়া করে বেড়াবে। দাঁড়াবার শক্তি দেবে না।
আরেকটা কথা শুনলে আতঙ্কে গা শিউরে ওঠে। "মেয়েদের সম্মান করতে শিখতে হবে"। কেন? শেখার কি আছে? এটা কি স্বাভাবিক না? পুরুষকে সম্মান করা শিখতে হবে বলে স্কুলে কিছু পড়ানো হয় বুঝি? তা হলে মেয়েদের সম্মান করাটা বিশেষ অনুশীলনের ব্যাপার কি করে হল? এটাও এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের আরেকটা ভণ্ডামি।
সর্বোপরি একটা কথা বলে শেষ করি, সেদিন আমার এক বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করলাম ওই পেরেক কারখানায় এত মেয়ে কেন? সে বলল, মেয়েদের পারিশ্রমিক কম দিতে হয়, তাই।
আমি হতবাক হলাম। হায় রে! কি পোড়ার নিয়ম! যাকে একই সাথে কখনো দেবী আবার কখনো দাসী বানিয়ে নিজের সুবিধা মত যাকে রাখা যায়, তার ক্ষেত্রে, ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি শব্দটা প্রযোজ্য তো হবেই!
যতদিন না মেয়েরা এই বোধটাকে স্বাভাবিকভাবে অর্জন করছেন, ততদিন এদের বিরুদ্ধে লড়ার মানসিক জোর পাবেন কোথায়?
এ বস্তাপচা, স্বার্থকেন্দ্রিক, মানসিকতা ছাড়তেই হবে। তবেই জোর করে কারোর শরীরের উপর চড়া ও হওয়াকে আর পুরুষত্ব দেখানোর ক্ষেত্র ভাবা যাবে না। একজন মেয়েকে 'নারীত্ব' শব্দটা ভুলে মনুষ্যত্বে উন্নীত হতে হবে। তবেই হবে।
সৌরভ ভট্টাচার্য
17 March 2015