জিম করবেট কোনো অব্যবস্থা বা অরাজকতা বোঝাতে যদি কেউ 'জঙ্গলরাজ" শব্দটা উপমা হিসাবে ব্যবহার করত, তবে উনি বিরক্ত হতেন। ওনার আজীবন জঙ্গলে ঘুরে মনে হয়েছে জঙ্গলের আইন মানুষের আইন থেকে অনেক বেশি সহনশীল, বোধগম্য। মানুষের সভ্যতা তা নয়। বড় বেশি নিষ্ঠুর আমাদের সভ্যতা।
আমি জানি না এই কথাটা লেখার জন্য জিম করবেটকে কেউ 'আগন্তুক' সিনেমার সংলাপের মত বলেছিলেন কিনা, "তবে জঙ্গলে গিয়েই থাকলে পারেন"!
করবেট খুব মিথ্যা তো বলেননি বলুন, বাঘ-সিংহ-ভাল্লুকের জন্য কোনো জঙ্গল হরিণশূন্য বা আর খরগোশ, কি কাঠবেড়ালি কি বাঁদর হনুমানশূন্য হয়েছে বলে তো শুনিনি। মানুষের জন্য যা হতে বসেছে। জঙ্গলই শূন্য হয়ে যাচ্ছে তো জঙ্গলের প্রাণী!
আসলে কথাটা কয়েকদিন হল উত্তর প্রদেশ নিয়ে এত শুনছি যে মনে এলো। কেউ কেউ তো আবার দেখছি তুলসীদাস অবধি পৌঁছে গেছেন। আবার কিছু গীতার শ্লোক তুলেও বলেছেন ওগুলোর জন্যেই নাকি এইসব। আমি শ্লোকগুলো বা উদ্ধৃতিগুলোকে সমর্থন করছি না, সে নিয়ে আগেও লিখেছি। কিন্তু কোনো শাস্ত্রে লেখা আছে বলেই যে আজ উত্তর প্রদেশের এই হাল, সে আমার অতিসরলীকরণ লাগে। বাঙালি মধ্যবিত্ত যে হারে কথামৃত পড়ে সে হারে সমাজে প্রভাব পড়লে তবে রামকৃষ্ণদেব যে হারে সত্যকথার গুণগান বা কামিনীকাঞ্চন ত্যাগের কথা পাতায় পাতায় বলেছেন তবে এদ্দিনে বাংলায় মিথ্যাভাষণ বলে কিছু থাকতই না, কিম্বা কণ্ডোমের চাহিদা বাংলায় সব চাইতে কম হত। কথাটা আসলে তা নয়। কথাটা বহুমাত্রিক। মানুষ কিসের অর্থ কি করবে তা তার রুচির উপর নির্ভর করে। যেমন একটা গল্প আছে, মহাভারত শুনে দাদু যখন জিজ্ঞাসা করল নাতি তুমি কি শিখলে? নাতি বলল সূচ্যগ্র জমির জন্যেও ভাইয়ের সাথে যুদ্ধে নামা যায়। দাদু খাবি খেয়ে নাতনিকে জিজ্ঞাসা করল, তুমি কি শিখলে? নাতনি বলল, ইচ্ছা করলেই পাঁচটা স্বামী রাখাই যায়।
ইতিহাস বড় জটিল। বহুমাত্রিক। লোকধর্ম আর চিরন্তন ধর্মের বাণীর মধ্যে পার্থক্য অনেক। একটা ইতিহাস। আরেকটা মানুষের ভাবের আদর্শ। রবীন্দ্রনাথ বলতেন গাছের পাতাগুলো ঝরে যায়, কিন্তু গাছটা থেকেই যায়। অনেক অনেক অপ্রাসঙ্গিক প্রথা সমাজে বেঁচে আছে আজকের দিনেও। পৈতে থেকে শুরু করে গর্ভবতী মহিলাকে সাধ দেওয়া অবধি। আজ তার দরকার নেই। যেমন একদিন ভারা বেঁধে বাড়ি বানানো হলেও সেই ভারা বাড়িটা বানানোর পর অপ্রাসঙ্গিক, এও তেমন। বাড়িটা সম্পূর্ণ হলে মিস্ত্রীরা ভারাটা খুলে নেন। সেইটাই স্বাভাবিক। ভারাটা বাঁধা না হলে বাড়িটাই তৈরি হত না - এই শ্রদ্ধায় যদি কেউ ভারাটা না খুলতে চায়, তা পাগলামি বলা চলে। সেরকমই সেদিন সমাজে নানা কারণে নানা আচার অনুষ্ঠান এসেছিল। যা আমাদের চোখে নিষ্ঠুর। অমানবিক। যেমন আজকের সমাজেও অনেক অমানবিক নিষ্ঠুরতা শিক্ষার নাম করে, স্বাস্থ্যসেবার নাম করে, শ্রেণী বৈষম্য বজায় রেখেই মেনে চলেছি, পালন করে চলেছি। এক পরিযায়ী শ্রমিকদের অমানবিক মৃত্যুলীলা ও সামাজিক উদাসীনতাই বুঝিয়ে দিল ভিতরে ভিতরে আসলে আমরা কতটা সভ্য। বাণিজ্যবোধে আর বিজ্ঞানের ব্যবহারে যা উন্নতি করেছি তাইতেই ধরাকে সরা দেখছি। অথচ কি নির্লজ্জতাকে স্বাভাবিক নিয়ম করে দেখছি, বলছি সমাজে ওরকম চলেই। নইলে সমাজ টেকে না। ক্ষমতার শোষণ সে যুগেও ছিল, এ যুগেও আছে। লড়াই সে যুগেও ছিল। এ যুগেও আছে। এর আরো ভালো ব্যাখ্যা হারারি আর সোশ্যাল ডিলেমা দেখিয়েছে।
ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার লড়াই কুকুরের লেজ সোজা করার মত। বিবেকানন্দর ভাষায়। তবু করে যেতেই হবে। কারণ সেটাই ধর্ম। মানু্ষের দুই ধরণের নম্রতা আছে। এক দোকানির নম্রতা বা আধুনিক ভাষায় ফুটেজ খাওয়ার জন্য পরিবেশনযোগ্য নম্রতা আর নিজের সীমারেখার উপলব্ধিজাত ঠিক ঠিক নম্রতা। প্রথমটার চক্করে সত্যকেই যেন গিলে না বসি রাহুর মত সে খেয়াল রাখতেই হবে। তবেই কুকুরের লেজ সোজা করার কাজটায় শ্রদ্ধা জন্মাবে। আর বিবেকানন্দর ভাষায় বলব, পৃথিবীতে একদিন স্বর্গরাজ্য প্রতিষ্ঠিত হবে এ সব গল্প বাচ্চাদের মানায়, আমাদের না।
আমাদের পক্ষ নির্বাচনটা করে নিতেই হবে। নিরপেক্ষ বলে জগতে মৃত্যু ছাড়া কেউ নেই। জীবন সব সময়েই পথ বেছে নেয়। জীবন মানে যখন সংগ্রাম হয়।