সৌরভ ভট্টাচার্য
31 May 2018
কথায় বলে – বাদ-বিতণ্ডা। কথা দুটো একসাথেই উচ্চারিত হলেও তাদের অর্থের ফারাক বিস্তর। বাদ – তত্ত্ব নিরূপণের জন্য তর্ক। বিতণ্ডা – স্বমত প্রতিষ্ঠিত হোক চাই নাই হোক, পরমত খণ্ডনের জন্যেই তক্ক। তবে এইভাবে বলি, এক হল গিয়ে তর্ক আর এক হল গিয়ে তক্ক।
ইদানীং পশ্চিম দেশে একটা তর্ক ও তক্ক'র দারুণ রব উঠেছে – The Intellectual Dark Web (IDW)। হয়েছে কি, বিভিন্ন ক্ষেত্রের মানুষজন নির্ভীকভাবে, এমনকি জনমতের, রাজমতের বিরুদ্ধে গিয়েও নিজেদের বিচার-বিবেচনা স্বাধীনভাবে উপস্থাপনার জন্য একটা platform বানিয়েছেন। কোনো মূলধারার পত্রিকায় কোনো আলোচনা ছাপা হবে না, বা দেখানো হবে না। YouTube, Podcast, Twitter ইত্যাদি গণমাধ্যমে আর নানা সভাগৃহে আলোচনা হতে পারে। শর্ত হল Politicaly corrtectness, Pseudo Intellectualism ইত্যাদি থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে হবে। এই IDW কথাটার সূত্রপাত করেন Eric Weinstain নামক এক আমেরিকান অর্থনীতিবিদ তথা লেখক। ঘটনার সূত্রপাত ঘটে Evergreen State College -এ Day of Absence বলে একটা অনুষ্ঠানে যখন সব শ্বেতাঙ্গদের কলেজ থেকে সরে থাকতে বলা হয়। এর প্রতিবাদেই এরিক সাহেব চটেন, আর এই IDW সূচনা ঘটান। ইতিমধ্যেই এটা তীব্র সাড়া ফেলেছে জনমানসে সেখানে। লোকে সাজানো সত্যি শুনতে শুনতে ক্লান্ত আসলে, তাই এই তৃষ্ণা একটা সঠিক অর্থে তর্কের - এমনটাই বক্তব্য এই তার্কিকমহলের সদস্যদের।
আমরাও ক্লান্ত। এক পয়সা পেট্রোলের দাম কমার মত রসিকতা সহ্য করার মত অবস্থায় আমরা হয়ত আর নেই। আমরা ‘সারা পথের ক্লান্তি’ আর ‘সারা দিনের তৃষা’ বয়ে বয়ে সত্যিই ক্লান্ত। ‘কেমন করে মেটাব যে’ সত্যিই ‘খুঁজে না পাই দিশা’। তখনই মনে এল শব্দটা – বাদ – তত্ত্ব নিরূপণার্থে কৃত তর্ক। সে তর্ক জাল বিস্তার করে না, সে তর্ক দিশা বার করে। কারণ এক একটা যুক্তি সেখানে গুহার দেওয়ালে আঘাত, আলোর তৃষ্ণায়। সে অন্ধকারের যন্ত্রণা না থাকলে এই তর্কে তো আমার অধিকার নেই। আমি তো বিবিক্তসেবী সন্ন্যাসী নই, না তো নির্বোধ – তবে? তবে এ দায় আমারও। সাবধান অন্ধকার থেকে না, সাবধান আলোর মত প্রহেলিকা থেকে, যা আলো নয়, কিন্তু আলো – ‘আচ্ছে দিন।‘
ঠুলি পরতে চাইলে ঠুলির অভাব নেই। কিন্তু ঠুলির অন্ধকার আর অন্ধত্বের অন্ধকারের মধ্যে একটা পার্থক্য তো থেকেই যায় না? দ্বিতীয়টায় আমি চাইলে কোনোদিন চক্ষুষ্মান হতেও পারি। আমার আলোর তৃষ্ণা মরেনি সেখানে, কিন্তু প্রথমটায় তো আলোই শত্রু। তাই ঠুলি যত মজবুত হয়, নির্বোধের স্বর্গের চারণক্ষেত্রও তত পরিব্যপ্ত হয়। চারণক্ষেত্র যত পরিব্যপ্ত হয় সদস্য সংখ্যাও তত বেড়ে ওঠে। আর সদস্য সংখ্যা যত বেড়ে ওঠে গণ-সম্মোহনের উল্লাসও তত তীব্র হয়। উল্লাস যত তীব্র হয় বিবেক-বিচার ততই নিষ্ক্রিয় অঙ্গ হয়ে পড়ে। ক্রমে ডাল ভেঙে পড়ার সময় হয়। একটা ডাল যখন মূল গাছ থেকে পৃথক হয়ে যায় নিজের বিশালত্বের অহংকারে আত্মতুষ্টিতে, বোঝা যায় তার শোকাবার সময় এলো। তাই শত শত সংখ্যা ছাড়িয়ে গেলেও ভেড়ার পালের গতিবিধি সংসারে একটা রূপকের স্থান নিয়েছে। তা খুব একটা গর্বের কি?
মুশকিল হল এই বিতণ্ডাপ্রেমীদের নিয়ে। আজকাল টিভিতে যে তর্কাতর্কি হয় সন্ধ্যেবেলা গোছ করে, তার অধিকাংশই ওই আমাদের আগের কথা অনুযায়ী তক্কা-তক্কি। ওতে কারেন্ট পোড়ে, মাথা গরম হয়, হাই ওঠে, সময় নষ্ট হয় – কাজের কাজ কিচ্ছু নয়। ওরা পরের দিনের বিষয় খোঁজে আর বিষজ্বালা ধরাতে পারে এমন লঙ্কামুখো, আচারমুখো লোক খোঁজে। মাঝে মধ্যে খানিক দামী কিছু হয় বটে, তবে কি আর করা, রাজরোষে সেধে তখনই পড়া যায় যখন সম্রাট তুষ্ট থাকে, তাই না? Pseudo intellectual -এর বাংলা কি হতে পারে - মেকি-বুদ্ধিজীবী? তা তাদের লক্ষণ কি? প্রথম লক্ষণ অবশ্যই বিতণ্ডা। দ্বিতীয়ত তারা নির্দিষ্ট ক্ষেত্রের বাইরে কথা বলবে না, কারণ তার ওই জমিটুকুই চাই। সত্যের জমি থাকে না, আকাশ থাকে। ক্ষুদ্র মতের একটা দুর্বল, স্বার্থান্বেষী, লোভী বুদ্ধিজীবী লাগে। যাদের দল থাকে, মত থাকে, পোশাক থাকে, বিশ্বাস থাকে – এগুলো সব ক'টাই থাকা ভালো, কিন্তু এগুলো সবই তাদের লাভের নিরিখে চূড়ান্তভাবে থাকে। তাই শব্দের যাদু, চাটনি থাকলেও সত্যের বোধের যে মর্যাদা তা থাকে না। সাময়িকভাবে জয়ী হয় কিন্তু বিশ্বাসযোগ্যতায় দাঁড় করানো দায় হয়। ক্রিটিকাল থিংকিং তো আর কোটেশান পড়ে জন্মায় না, না তো শুধু নিজের অভিজ্ঞতা বা স্বার্থের ঘরে ঘুঁটি তুলে। সে জন্মায় সৎ, নির্ভীক মননের গর্ভে। সে গর্ভ-যন্ত্রণা তারা সইবে কেন? এই মেকি-বুদ্ধিজীবী শ্রেণীতে ভর্তি চারদিক আজ। লোকে খাচ্ছে, তাই এরা আগাছার মত বাড়ছে। কথার পর কথা জমছে। ডেসিবেল চড়ছে, ম্যানিফেস্টোর নতুন সংস্করণ হচ্ছে কিন্তু “রাজা তোর কাপড় কোথায়” বলা শিশুটাকে আর পাওয়া যাচ্ছে না। সে ব্যস্ত গুগুল প্লে স্টোরে, জিও!
তবে কি এ সব কথা সেই কবি বহুকাল আগে বলে গেছেন, কেউ তেমন আমল দেয়নি তা আর কি করা... এখনও তিনি আমাদের সাথে একই কালের বাতাসে শ্বাস নিচ্ছেন... কিন্তু বহকাল কোনো কণ্ঠস্বর শুনতে পাই না বলে বড় কষ্ট লাগে। কি বলেছিলেন তিনি –
“বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখ দ্বিতীয় বিদ্যায়।
বরং বিক্ষত হও প্রশ্নের পাথরে।
বরং বুদ্ধির নখে শান দাও, প্রতিবাদ করো।
অন্তত আর যাই করো, সমস্ত কথায়
অনায়াসে সম্মতি দিও না।
কেননা, সমস্ত কথা যারা অনায়াসে মেনে নেয়,
তারা আর কিছুই করে না,
তারা আত্মবিনাশের পথ
পরিস্কার করে।”
- নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী