Skip to main content
 
 
        এ আলোচনাটা কিছুটা আত্মগত। নিজের মধ্যে উত্তর খোঁজা। তার প্রধাণ কারণ এই আলোচনা করার বৈধ যোগ্যতা আমার কোনো অর্থেই নেই। তবু মন থাকলে গতি থাকবে। আর মনের গতি তো চিন্তা। চিন্তা আর কবে সরলরেখায় হল? চিন্তা কখনও আবর্ত, কখনও খাদের কিনারায়, কখনও মাঝসমুদ্রে। কখনও সখনও সবুজ মাঠের মধ্যে হাত পা ছড়িয়ে টানটান আকাশের দিকে চেয়ে শুয়ে থাকে না যে তাও নয় অবিশ্যি। সেই চিন্তার কিছু কথা।
 
        কিছুদিন আগে দক্ষিণ ভারতের একজন খ্যাতনামা সংবাদ পাঠিকা বহুতল আবাসন থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। নিজেকে শেষ করার আগে তার স্যুইসাইড নোটে লিখে যান, “আমার মস্তিষ্কই আমার সবচাইতে বড় শত্রু। কি কারণে লিখেছিলেন আমি জানি না। ইচ্ছা হয়নি। কিন্তু কথাটা খুব খাঁটি। আমার অনেক লেখায় (বিশেষ করে ধর্মপ্রসঙ্গে) অনেকে প্রতিবাদ করে আমায় মেসেঞ্জারে অথবা সাক্ষাতে বলেন যে, “আমি আপনার সাথে যুক্তিতে পারব না, কিন্তু আপনি ভুল। আমার উত্তরটা খুব ঘোরালো লাগে। যুক্তিতে পারা না পারার কি আছে, যদি না অপযুক্তি থাকে? যুক্তি তো পেশীশক্তি নয় যে সে অন্ধ, সে তো সত্যের তীর ধরে ধরে হাঁটতে পছন্দ করে। কিন্তু না, তারা সে কথা মানতে নারাজ। তখন বুঝি আসলে কোথাও একটা তাদের সুলালিত প্রাচীন ধারণায় আঘাত করছে। এবং সেটা যে অন্ধ তারা নিজেরাও জানেন, কিন্তু সে কথা প্রকাশ্যে আলোচনা পছন্দ করেন না।
        যেটা বলছিলাম, “মস্তিষ্কই আমার সবচাইতে বড় শত্রু। ঠিক। দস্তয়েভস্কি তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘Notes From The Underground’ এ লিখছেন - Consciousness is a disease. অস্তিত্বের গভীরে একটা যন্ত্রণা। অব্যক্ত যন্ত্রণা। প্রশ্নের যন্ত্রণা। রহস্যময়তার অন্ধকার। পথ নেই। আলো নেই। শুধু অনুমান। অনুমানের কোনো নিশ্চয়তা নেই। তবে? এই অনিশ্চয়তাতেই জীবন। জীবন শুধু পদ্মপাত্রের আগায় জল টলটল জলবিন্দু নয়, জলকণাগুলোর মধ্যে নিবিড় ঘন অবিরাম সংঘর্ষ।
        প্রাচ্য আর পাশ্চাত্য দু'ভাবে এ প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। প্রাচ্যের আত্মদর্শন প্রধান। আত্মার দর্শন। অতিজাগতিক বিশ্বাসের দর্শন। তার প্রমাণ নেই। অনুমান আছে। অতীন্দ্রিয় অনুভবের উপাখ্যান আছে। কিন্তু তা সার্বজনীন নয়। কিন্তু বহুচর্চিত হওয়ার জন্য তা লোকপ্রিয়। আমরা জন্ম থেকেই আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাসী। এ নিয়ে আমাদের কোনো সংশয় নেই। এর বিরুদ্ধে চিন্তা করতেই বরং আমাদের সচেতন অভ্যাস করতে হয়। এতটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে এ ধারণা আমাদের অবচেতনে। আসলে একটা সমষ্টিগত অবচেতন তো থাকেই প্রত্যেকটা সমাজে। যা আমাদের চাল-চলন-বিবেক-বিচার নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের অলক্ষ্যে।
        পাশ্চাত্য এর কোনো সহজ মীমাংসা দেয়নি। বৌদ্ধদর্শনে খানিক অনাত্মবাদের কথা এলেও পুনর্জন্মবাদের চক্করে সে তত্ত্ব খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠেনি। যদিও বৌদ্ধ দার্শনিকেরা অতি সুক্ষ্ম বিচারে বোঝাতে চেষ্টা করেছেন যে বেদান্তের আত্মার সাথে জড়িত পুনর্জন্মবাদ আর তাদের পুনর্জন্মবাদ আলাদা। তবু কোথাও একই গোত্রের হয়ে দাঁড়ায় কারণ মৃত্যুর পর কিছু একটা অস্তিত্বে তারা বিশ্বাস করেন যা আবার জন্মলাভ করবে। পাশ্চাত্যে সুবিধা হল ওদের ধর্ম আর দর্শন কিছুটা কাছাকাছি কোনো একটা সময়ে এলেও গুলিয়ে যায়নি একটার সাথে আরেকটা। তার ফলে দর্শনটা স্বাবলম্বী হয়ে নিজের শাখা-প্রশাখাকে বিচিত্র চিন্তা আর ভাবের শক্তিতে বিকশিত করার সুযোগ পেয়েছে। আমরা যেটা পাইনি। আমাদের ধর্ম আর দর্শন একে অন্যের সাথে মিথোজীবিতায় বেড়ে উঠেছে। তার ফলে দর্শনটা ঠিক স্বাবলম্বী কোনোদিনই হয়ে ওঠেনি। তাকে আত্মার অমরত্ব এবং বিশ্বের এক পরম সত্য ব্রহ্মের কাছে বরাবর নিজের নজরানা দিয়ে আসতে হয়েছে। চার্বাক ইত্যাদি ছিল যদিও তবে ততটা গভীরতায় তারা পৌঁছিয়েছে বলে আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয় না।
        পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসের ধারা বিচিত্র আগেই বললাম। এখানে একটা কথা শুধরে নিই, সরাসরি প্রাচ্য দর্শন বলা হয়ত আমার উচিৎ হচ্ছে না। কারণ প্রাচ্যে আরো অনেক দর্শন উঠে এসেছে চীনে, জাপানে যা অত্যন্ত গভীর, এবং অবশ্যই অনেকটা অতীন্দ্রিয়ের রহস্যময়তা মুক্ত। আমার আলোচনায় আমি বিশেষ করে ভারতের দর্শনের কথা বলতে চাইছি। পাশ্চাত্যের যতগুলো দর্শন আছে আমি বিশেষ করে তার অত্যাধুনিক দর্শন অস্তিত্ববাদ’-এর কথা বলছি।
        অস্তিত্ববাদের মূল কথা প্রথমে আমার অস্তিত্ব তার পরে যা কিছু সারবত্তার প্রশ্ন। নিজের অস্তিত্বের নিরিখে সব কিছুকে ব্যাখ্যা করতে চাওয়া। সব কিছুর অর্থ খুঁজতে যাওয়া। আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয় পৃথিবীর কোনো দর্শনই এই মূল জায়গাটা থেকে সরতে পারে না। নিজের অস্তিত্বের সাথে তাকে একটা বোঝাপড়ায় আসতেই হয়। যে ভাবেই হোক। জীব নিত্য কৃষ্ণদাসথেকে শুরু করে মানবতাবাদতথা মানবতন্ত্রেরমূল কথাটাই এই বোঝাপড়া করতে চাওয়া। সমষ্টির সাথে নিজের ব্যষ্টিসত্তার যোগসূত্রটা খুঁজতেই হবে। সমষ্টিকে কখনও ঈশ্বরের নামে কখনও নানা –‘ইজম্’-এর নামে মানুষ ব্যাখ্যা করতে চেয়েছে। সেই ব্যাখ্যাগুলো বদলে বদলে গেছে কিন্তু ব্যষ্টি বদলায়নি। সারা বিশ্বের ধর্মের সাথে ধর্মের না মিললেও তাই পৃথিবীর যে কোনো মানবসাহিত্যের সাথে মানুষের একাত্ম হতে অসুবিধা হয়নি। রাশিয়ার কোনো গ্রাম্য নারীর উপাখ্যানেও আমার চোখে জল এসেছে, আবার দূর্গার মৃত্যুর বর্ণনাত্মক দৃশ্য সে দেশের মানুষের চোখের কোল ভিজিয়েছে। মূল কারণ আমাদের অস্তিত্বের অনুভূতিটা যে এক। আর কিছুকে নিয়ে আমাদের সংশয় এলেও নিজের অস্তিত্বকে নিয়ে তো কোনো সংশয় আসেনি। যদিও নীৎজের তত্ত্বতে সে খানিক ঝলক দিয়েছিল কিন্তু সার্ত্রের দর্শনে সে আত্মধ্বংসের পথ থেকে রক্ষা পায়। সার্ত্রে মানুষের অস্তিত্বের গভীরে একটা প্রতিশ্রুতি দেখেছিলেন। ‘Bad Faith’ নামক মলিন, অসত্য আত্ম-অবমাননাকর মোহময়তা থেকে নিজেকে রক্ষা করার তাগিদ খুঁজে নিতে বলেছিলেন। যদিও অস্তিত্বের গভীরে অর্থহীনতার যন্ত্রণা অস্বীকার করেননি, কিন্তু তার কাছে হেরে যাওয়াকেই মানুষের চরম পরিণতি বলে মানতেও চাননি।
        তবে ব্যষ্টির সাথে সমষ্টির যোগসূত্র না, ব্যষ্টির মধ্যেই ব্যষ্টিকে তীক্ষ্ম নজরে দেখার প্রথম প্রয়াসটা খুব সার্থকভাবে বোধহয় দস্তয়েভস্কি করেন। অবশ্যই তার ‘Notes From The Underground’ গ্রন্থে। সেই বিশ্লেষণ তার ‘Brothers Karamazov’-এও গভীর। তবে তাকে পরবর্তী সময়ে একটি স্বাবলম্বী মৌলিক দর্শনরূপে দাঁড় করান কাম্যু (বিশেষ করে The Stranger উপন্যাসে), সার্ত্রে (বিশেষ উল্লেখ্য ‘Being and Nothingness’ এবং ‘Nausea')মূল কথা হল কোন প্রচলিত বিশ্বাস, ধ্যানধারণার স্রোতে গা ভাসানো নয়। নিজের অস্তিত্ত্বকে পর্যবেক্ষণ, অনুভব, বিশ্লেষণ। এর কোনোটাই অতীন্দ্রিয় রহস্যময়তায় নয়, বরং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সংবেদনে এবং যুক্তিগ্রাহ্যতায়। কোন আনন্দের প্রতিশ্রুতি নেই, কোন পূর্বপরিকল্পিত বিশ্বাসের কাছে দায়বদ্ধতা নেই। দায়বদ্ধতা সত্যের কাছে এবং নিজের মোহমুক্ত পক্ষপাতরহিত ধীশক্তির কাছে। যা লালন করার ক্ষমতা রাখে স্থায়ীত্বকে সত্তার বিবর্ধনে। যদিও মানুষের অসীম ক্ষমতা আত্মধ্বংসের, কিন্তু তা কোন অর্থেই যুক্তি ও সুবিবেচনা অনুমোদিত হতে পারে না। নিজের অস্তিত্বকে রক্ষা করে চলার মধ্যেই নিহিত আছে অন্যের অস্তিত্বকে রক্ষা করার দায়বদ্ধতা। শুধু যে সমষ্টি দ্বারাই ব্যষ্টি প্রভাবিত হয় তা তো নয়, ব্যষ্টিরও দায় থাকে সমষ্টির দিকে।
        এতক্ষণ যা বললাম, তা হয়তো একটা ভূমিকা বলা যেতে পারে। রবীন্দ্রনাথ তার বিশ্বাসের গভীরে রেখেছিলেন উপনিষদের বিশ্বাসকে --- 'আনন্দাদ্ধ্যেব খল্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে' --- আনন্দ থেকে এ জগতের সৃষ্টি। মানুষের কেন্দ্রে এক আনন্দময় সত্তার অস্তিত্বে তিনি বিশ্বাস করতেন। উপনিষদের ভাষায় যা সৎ-চিৎ-আনন্দস্বরূপ, যা অমর। এই ক্ষুদ্র আত্মার সাথে ইন্দ্রিয়াতীত এক পরম মঙ্গলময় কারুণিক ব্রহ্ম তথা ঈশ্বরের অস্তিত্বেও বিশ্বাসী ছিলেন। যিনি তার প্রেমে কখনো কখনো যেন অত্যন্ত মানবিক।
        কিন্তু আমার খটকা লাগে রবীন্দ্রনাথ তার শেষ কয়েকটা কবিতায় তিনি যেন ক্রমশ বেদান্তর ব্রহ্ম থেকে ভবিষ্যতকালের দর্শন অস্তিত্ববাদের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। প্রথম দিনের সূর্য এবং দিবসের শেষ সূর্য সত্তার নতুন আবির্ভাবে অথবা বৎসরান্তের শেষে উত্তর না পেয়ে ফিরে যায় --- 'পেল না উত্তর'। শুধু কি এখানেই ক্ষান্ত হলেন? বললেন --- 'আমৃত্যুর দুঃখের তপস্যা এ জীবন / সত্যের দারুণ মূল্য লাভ করিবারে'; অথবা 'সত্যেরে সে পায় / আপন আলোক ধৌত অন্তরে অন্তরে'... কিম্বা... সত্য যে কঠিন, / কঠিনেরে ভালবাসিলাম / সে কখনো করে না বঞ্চনা। এ সত্য কোন সত্য? এ তো আনন্দময় সত্তা নয়। এ তো আত্মার অমরত্বের বিজয় তোরণ নয়! এ তো পরম কারুণিক পরমেশ্বরের আশ্বাসের শান্ত তৃপ্ত মুগ্ধ চিত্ত নয়! এ কোন রবীন্দ্রনাথ? যিনি বলেন অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে / সে পায় তোমার হাতে / শান্তির অক্ষয় অধিকার। কোন ছলনা? ব্রহ্ম'? আত্মার অমরত্বের? উপনিষদের প্রতিশ্রুত গভীর আনন্দের? তাই কি অবশেষে অস্তিত্ব'র সত্য যে গভীর দুঃখ তাকে স্বীকার করে নেওয়া? নির্মোহ সত্যকে স্বীকার করে নেওয়ার মধ্যে যে শান্তি, অবশেষে সেই কি হল তার শেষ আশ্রয়? তেমন কথাও যে বলেননি তা তো নয়! বলেছেন, ‘এই বাহ্য আবরণ, জানি না তো, শেষে / নানা রূপে রূপান্তরে কালস্রোতে বেড়াবে কি ভেসে। / আপন স্বাতন্ত্র‍্য হতে নিঃসক্ত দেখিব তারে আমি / বাহিরে বহুর সাথে জড়িত অজানা তীর্থগামী
 
        এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া সোজা নয়, কিন্তু তবু নিজের জন্য এই উত্তর যে পেতেই হবে। বিজ্ঞান তো শুধু জড়ের রাজত্বে বিরাজ করে না, সে এমন গভীর সত্যের সন্মুখে দাড় করায় বারবার যা বিশ্বাসের অন্দরমহলে বহু লালিত পালিত অচলায়তনের ভিত নাড়িয়ে দেয়। নতুন দর্শনের জন্ম হয়, যে দর্শন শুধু বিশ্লেষণের কথা বলে না, নতুন আলোতে নতুন করে সংশ্লেষের কথা বলে।