সৌরভ ভট্টাচার্য
1 July 2019
এ জগত তোমার প্রয়োজনের জন্য পর্যাপ্ত, তোমার লোভের জন্য নয় - মহাত্মা গান্ধী
ধর্মহীন, দর্শনহীন, আদর্শহীন একটা সময়। বুদ্ধি তীক্ষ্ম। কিন্তু বুদ্ধির উপর ভরসা নেই। যে যত বুদ্ধিমান তাকে তত ভয়, তাকে তত সন্দেহ, তাকে তত নজরে রাখা – মতলবটা কি? বুদ্ধি এভারেস্টের চূড়ায় পতাকা পুঁতছে, বিশ্বাস এগোচ্ছে না। বিশ্বাস গলে গলে সংশয় নদী। বিষাক্ত জল। দুর্গন্ধ। বুদ্ধি নিষ্ঠুর। বুদ্ধি স্বার্থপর। বুদ্ধি একমেবদ্বিতীয়ম হবে - বাসনা। বুদ্ধি চরকার মত। নিজেকে পুড়িয়ে সব পুড়িয়ে ছারখার করে নিজে নিঃস্ব। বুদ্ধি ফ্রাঙ্কেস্টাইন।
বুদ্ধি – জলশূন্য পৃথিবী। বুদ্ধি – পারমাণবিক বোমা সমৃদ্ধ পৃথিবী। বুদ্ধি – বিশ্ব উষ্ণায়ণের পৃথিবী। বুদ্ধি – মানবিকতা শূন্য পৃথিবী। বুদ্ধি – মঙ্গলাকাঙ্ক্ষা শূন্য দর্শন। বুদ্ধি – প্রজ্ঞাহীন আস্ফালন। বুদ্ধি – অনুকম্পাহীন লোভের সহোদর। বুদ্ধি – সন্দেহের সিল্করুটে খাদের আশ্বাস। বুদ্ধি – অশান্ত, এখনই...। বুদ্ধি – আমি আমি আমি...
প্রজ্ঞা – শান্তি। প্রজ্ঞা – আহরিত না, অর্জিত। প্রজ্ঞা – চর্চিত না, উপলব্ধিগত। প্রজ্ঞা – স্মৃতিগত না, অনুকম্পাসিক্ত। প্রজ্ঞা – ব্যক্তিপুষ্ট সত্তা না, সমষ্টিপুষ্ট সত্তা। প্রজ্ঞা – জন্মলব্ধ, স্বভাবসিদ্ধ, আবিষ্কারমুখাপেক্ষ।
প্রজ্ঞা ভালোবাসা। প্রজ্ঞা অনুকম্পা। প্রজ্ঞা নির্বৈরিতা। প্রজ্ঞা ধৈর্যশীলা। প্রজ্ঞা আলোকস্বরূপা।
পৃথিবী জলশূন্য হতে চলেছে – এ বড়কথা না। এ ফলাফল। পৃথিবী প্রজ্ঞাশূন্য হয়ে পড়ছে, বহুকাল। অনেকে বলেছে – শুনিনি। একটা গল্প - ভাগবতে আছে, ধর্ম আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে গাভীর বেশে শুয়ে, তার চারটে পা। কি কি চারটে পা – তপস্যা, শৌচ, সত্য ও করুণা। এ সকলের মধ্যে বলা হচ্ছে করুণাই একমাত্র যা পালনীয় কলিযুগে। কলিযুগ কি? জানি না। তবে হয়ত বলা হচ্ছে অন্ধাকারের যুগ, সংশয়ের যুগ। করুণা কি? প্রজ্ঞার জননী। “জ্ঞানের বিহনে প্রেম নাই”, আমার সময়ের কবি বললেন – এ কোন প্রেমের কথা? এ কোন জ্ঞানের কথা? কোথায় জ্ঞান মানে প্রেম আর প্রেম মানে জ্ঞান। যেখানে যেখানে মানবিকতা বিকাশের প্রতিষ্ঠান। প্রথম, বিদ্যালয়। শিক্ষা জ্ঞান ও ভালোবাসার ভিত্তিতে হওয়ার কথা ছিল। দ্বিতীয়, বিচারালয় – বিচার জ্ঞান ও অনুকম্পার সমীকরণে দাঁড়াবার কথা ছিল। চিকিৎসালয় – জ্ঞান ও সহানুভূতির সাহায্যে দাঁড়ানোর কথা ছিল। হল না।
কেন? কারণ, লোভের সাথে সিঁধ কাটল বুদ্ধি। জ্ঞান ও প্রেমের স্বরূপ – প্রজ্ঞাকে সরিয়ে বুদ্ধি আর লোভ এল বিচক্ষণতা, তাৎক্ষণিক লাভের ছদ্মবেশে। ঊর্দ্ধে ওঠা হল, উদ্ধার হওয়া হল না। সত্য নেই, শুদ্ধতা নেই, তপস্যা নেই, করুণা নেই। আছে তত্ত্বের পর তত্ত্ব। ছুরি ধার করার প্রতিযোগিতা। ধার যত তীক্ষ্ণ, তত নেশা। যত নেশা তত ঘোর। তত বেগ। যত বেগ তত অন্ধতা। যত অন্ধতা তত উল্লাস। ক্রমে সেই তীক্ষ্ম ধারে নিজের হাত ক্ষত বিক্ষত। প্রথমে আঘাত। তারপরে সয়ে যাওয়া। তারপরে কড়া পড়ে যাওয়া। তারপর আরো তীক্ষ্ণ ধার। সেই কড়া চিরে রক্ত। আবার আঘাত, আবার কড়া পড়ে যাওয়া। সভ্যতা এগোচ্ছে। কড়ার পর কড়া পুরু হচ্ছে। মাঝে মাঝে রক্তপাত। চীৎকার। আবার সয়ে যাওয়া। আবার কড়া পড়া। আবার ধার করার প্রতিযোগিতা। এখন নেশা।
এমনভাবে কড়া পড়তে পড়তে, ধার তীক্ষ্ণ হতে হতে...আমাদের সম্বল - তীক্ষ্ণ ক্ষুরধার বুদ্ধি, যা অযুত নিযুত আলোকবর্ষ দূরে থাকা নক্ষত্রের আলোয় চকমকিয়ে উঠছে, সাথে কড়াপড়া মানুষ।
প্রজ্ঞা, বুদ্ধির চর্চায় না, বুদ্ধির নিয়ন্ত্রণে। প্রজ্ঞা সহজাত স্বভাবগত বুদ্ধি না, যা প্রতিটি প্রাণীর আছে, যা instinct। প্রজ্ঞা – সহজাত করুণাগত বিবেক – অনুশাসন। উদারচেতনার ঈশ্বরের সংজ্ঞা। উদারচেতনার নাস্তিকের শুভবুদ্ধি – “love is wise” – Bertrand Russell. “শুভ বুদ্ধিই ঈশ্বর” – রামকৃষ্ণ। “whoever is granted wisdom has indeed been granted abundant wealth” Quran. (2.269)
এমন বাণীর উদাহরণ অজস্র। এমন কাজের উদাহরণ – নগণ্য। তাও পৃথিবীটা এতদিন চলছে – এই আশ্চর্য! ভালো করে ভেবে দেখুন – শুধুই জলশূন্যতার সমস্যা? আর সব পূর্ণ?