মন আর শরীর। এ দুটোই অস্তিত্ব। ভাগাভাগি করে নেই, বেশ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে।
কিন্তু এই দুটোতেই তো পরিচয় শেষ হয় না আমার। পরিচয় হয় সম্পর্কের সূত্রে। সম্পর্ক মনের সাথে, শরীরের সাথে। শুধু আমার না, আমার চারপাশের সাথেও। শুধু জীবন না, জড়ের সাথেও। বিভিন্ন সম্পর্কের সূত্রে পরতে পরতে গড়ে ওঠে আমার এই পরিচয়।
তবে ঠিক সেটা নিয়ে লিখব বলে ভাবিনি। বলতে চাই সম্পর্কশূন্যতার কথা। এমন অনেক সময় দেখেছি কোনো কোনো মানুষ কোনো সম্পর্কেই নিজেকে খুঁজে পাচ্ছেন না। নিজের মধ্যে খুব একটা নিবিড় যোগাযোগ অনুভব করছেন না কারোর সাথেই। হতে পারে বিশ্বাসঘাতকতা, গভীরভাবে অপমানিত হওয়া ইত্যাদি কিছু ঘটেছে অতীতে তাঁর জীবনে, অথবা তাঁর মানসিক গঠনটাই সেই রকম।
যখনই কোনো মানুষ মনের সাথে সম্পর্ক গড়তে ব্যর্থ হয়, দেখেছি তার মধ্যে একটা বিকারের আশঙ্কা তৈরী হয়। শরীর সক্রিয় হয় মনের চেয়ে বেশি। ক্রমশ সে অভ্যাস ব্যাধির আকার ধারণ করে। যাকে আমরা ইংরাজীতে perverted ব্যক্তি বলে থাকি। কেন ব্যর্থ হয় তার নানান কারণ থাকতে পারে। সেটা আগেই বলেছি।
মনের সাথে মনের যে সম্পর্ক তা স্বাভাবিকভাবে সমাজের সাথে ভাবে সুস্থ রাখতে, যুক্ত রাখতে সাহায্য করে। নিজের মধ্যে নিজেকে সঙ্কুচিত করে না রেখে, অন্যের মনের মধ্যে মুক্তি পায়। পরিণত হয় তার জীবনবোধ দায়িত্ববোধের সাথে। অফিস কাছারির দায়িত্ব আর সম্পর্কের দায়িত্বের মধ্যে একটা বিস্তর ফাঁক আছে। দায়ের দায়িত্ব সমাধা করে মানুষ ছুটি খোঁজে, আর সম্পর্কের দায়িত্বের মধ্যে সে নিজের সার্থকতা খোঁজে। দ্বিতীয়টার অভাব মানুষের জীবনে যে রিক্ততা আনে, তা পূরণ করার মত ক্ষমতা সব মানুষের জন্য না। সে ক্ষমতা সৃষ্টিশীলতার ক্ষমতা। বহু মানুষ কোনো ব্যক্তিগত সম্পর্কে না গিয়ে কোনো একটি সাধনায় নিজেকে নিমজ্জিত করেছেন আজীবন - এরকম উদাহরণের অভাব নেই। কিন্তু তা সার্বজনীন হতে পারে না। সে ক্ষমতা, সে অধ্যবসায় বিধাতা সবার জন্য নির্দিষ্ট করেননি।
তাই অন্যভাবে বললে হৃদয়বৃত্তির শূন্যতাই মানুষকে বিকারগ্রস্থ শারীরবৃত্তির বন্ধ্যা নিগড়ে বেঁধে ফেলে। সে একই আবর্তে ঘুরেই চলে, ঘুরেই চলে। শরীরের কোনো নীতি নেই, শপথ নেই। সে আদিম কাল থেকে একটাই শব্দ চেনে - সুখ। আগুনে হাত দিয়েছে, হাত পুড়িয়ে সরে এসেছে, খাদে পড়ে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে, খাদের ধার থেকে সরে এসেছে। এরকমই তার স্বভাব। আগুনে তার ভয়, খাদে তার ভয়, ঝড়ে তার আতঙ্ক, মৃত্যু তার কাছে বিনাশ। সুখই তার একমাত্র চালনাশক্তি। তার দিশা। তার ধর্ম শুধুই ভোগ।
অন্যদিকে মনের একটা নীতি আছে। ধর্মবোধ আছে। প্রেয়র থেকে শ্রেয় তার কাছে বেশি গৌরবের। শরীরের মত সে সুখে নিজেকে সার্থক ভাবে না। সে সার্থক বীরত্বে। মর্যাদায়। ভালবাসায়। সে আগুনকে বশে আনতে চায়, খাদের ধার ঘেঁষে হাঁটতে চায়। কারণ সে ভয়কে জয় করতে চায়। ভয়ের ওপর তার একটা ঘৃণা আছে। তার কাছে হেরে যেতে সে লজ্জাবোধ করে। শরীরের লজ্জাবোধ নেই, তার আছে। কারণ সে বুঝেছে, সবার সাথে এক হলেও কোথাও সে স্বতন্ত্র। এই স্বাতন্ত্র্যবোধকে সে পরম বলে জানে। এর নাম সে দিয়েছে - ইচ্ছা। বাসনা না। শরীরের আছে বাসনা। চির অতৃপ্ত, আগুনের মত বাসনা। মন তার ইচ্ছাশক্তি দিয়ে তাকে দমন করেছে। সভ্য হয়েছে। বুঝেছে শরীর তার চালনা শক্তি না। সে অন্ধ ঘোড়ার মত। তার চালনা শক্তি হল তার মধ্যের শুভ বোধ।
এমনকি সে এ অসীম ব্রহ্মাণ্ডের সাথেও নিজের সম্পর্ক তৈরী করেছে। নাম দিয়েছে ঈশ্বর। সে সমাজ গড়েছে। শিখেছে নতুন একটা শব্দ - ত্যাগ। ঠিক সন্ন্যাসীর ত্যাগ না। বড়র ছোটোর জন্যে ত্যাগ। মানিয়ে নেওয়া। ছেড়ে দেওয়া। দুর্বলকে রক্ষা করা। নিজের মহত্বকে অনুভব করা। রূপ নিয়েছে ধর্ম।
এই গতির বিপরীত যে গতি? যেখানে প্রেমশূন্যতা মরুভূমির মত হৃদয়কে দখল করে পড়ে আছে। সেখানেই দেখেছি বিকারগ্রস্ত কামের প্রেতনৃত্য। তার বিকৃত সুখের নানান ওজর।
উপায় কি? ধর্মের বুলি না। সৎ উপদেশ না। তাকে নিজেকে একটা সম্পর্কের বাঁধনে বাঁধতে হবে। মনের সাথে। কাউকে অথবা কিছুকে নিজের মনের সবটুকু দিতে হবে। আবেগে না, প্রতিশ্রুতিতে। সেই বাঁধন চিরাচরিতভাবে বৈবাহিক না হলেও, বিবাহের মূল সুরটি তাতে বাজবেই বাজবে। বরং তথাকথিত বহু বিবাহেই দেখেছি বাইরের সানাই কেঁদে ফিরছে কৃত্রিম সাজসজ্জা ছেয়ে। প্রাণের সুর বোবা সেখানে - অনিচ্ছায়, বাধ্যতায়।
তা না। তা চাই না। ভালবাসা আসুক শুষ্ক হৃদয়ে। সম্পর্ক গড়ে উঠুক। ঝড়-ঝাপটা থেকে দু'জনে রক্ষা করুক নিজেদের সম্পর্ককে। সেখানে কোনো আড়াল না থাকুক। তা হলে কোনো বাধাই কোনো সম্পর্কের বিনাশ ঘটাতে পারবে না। কারণ বিষবৃক্ষের বীজ বোনা হয় আড়ালে। আড়াল না থাকলে বিষ জমবে কোথায়? অন্ধকারে মজে বিষ, আলোতে জমে অমৃত।