“না চাহিতে মোরে যা করেছ দান - আকাশ আলোক তনু মন প্রাণ
দিনে দিনে তুমি নিতেছ আমায় সে মহা দানেরই যোগ্য করে”
দানের জন্য যোগ্য হতে হয়? শুনেছিলাম তো উপার্জন করার জন্য যোগ্য হতে হয়। দান পাওয়ার জন্যেও যোগ্য হতে হয়?
অহংকার বুঝতে চায় না। চেতনা অনুভব করে, সে যা পেয়েছে, দান হিসাবেই পেয়েছে। আকাশ, আলো, তনু, মন, প্রাণকে আমি কি অর্জন করেছি? আমি তো পেয়েছি। দান হিসাবে পেয়েছি। ভিক্ষা নয়, দান। ভিক্ষা সম্পূর্ণ নির্ভর করে যে ভিক্ষা দিচ্ছে তার উপর। কিন্তু দান? সে নির্ভর করে যে দান গ্রহণ করবে তার উপর। শিক্ষক যা শেখাতে চান, সে তিনি আন্তরিকভাবে সবটুকুই শেখাতে চান সবাইকে। কিন্তু সে শিক্ষা কি সবার অন্তরে সমান মাত্রায় গিয়ে দাঁড়ায়? না, সে নির্ভর করে যে শিখছে তার উপর। সে কতটা প্রস্তুত তার উপর।
সংসারে রাতদিন খেটে মরছি শান্তি আর সুখের জন্য। সুখ কিনতে পাওয়া যায়। কিন্তু শান্তি? শান্তি কেনা যায় না। কারণ শান্তি হল দানের বস্তু। শান্তি উপার্জন করা যায় না। আজকাল যদিও কর্পোরেট অধ্যাত্মিকতার জগতে তাও বিজ্ঞাপিত হচ্ছে। কিন্তু সে তো শান্তি নয়, সে ক্ষণিকের জন্য বিরাম। আরেক নতুন অভ্যাসের মাধ্যমে। সে প্রাণায়াম, কি ধ্যান, কি যোগ, কি আরো নানা অভ্যাসের মাধ্যমে কিছুক্ষণের জন্য মনকে অন্যভাবে বিশ্রাম দেওয়ার ব্যবস্থা। কিন্তু শান্তি তার চাইতে অনেক গভীরের বস্তু। আরো গভীরে তার শিকড়। শান্তি দানের বস্তু, উপার্জনের নয়। এটা আগে বুঝতে হবে। শান্তি ফাঁকি দিয়ে পাওয়া যায় না। শান্তি পাওয়ার জন্য মনকে প্রস্তুত করতে হবে। সে শিক্ষা পেতে হবে। তার জন্য কোনো পাহাড়ের গুহা, সমুদ্রের তীর, কোনো মন্ত্র, কোনো গুরু, কোনো গুপ্তবিদ্যা কাজে লাগবে না। হ্যাঁ, এরা প্রত্যেকেই হয় তো কিছুটা সহায়তা করতে পারে, কিন্তু আদতে এরা কেউ শান্তি দিতে পারে না। শান্তি আসে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে। তার জন্য নিজেকে প্রস্তুত হতে হবে।
রামকৃষ্ণদেব বলছেন, “আমি”রূপ ঢিবিতে কৃপারূপ জল দাঁড়ায় না। “আমি”কে চোখের জলে ডুবিয়ে দাও। আরো বলছেন, “উঁচু জমিতে জল দাঁড়ায় না। নীচু জমিতে দাঁড়ায়”। তুলসীদাস বলছেন, তুমহরি কৃপা, তুমহহি রঘুনন্দন… তোমার কৃপা তুমি নিজেই হে রঘুনন্দন। এই কৃপা মানে কি? ধন সম্পদ, নামযশ, স্বাস্থ্যসুখ… কিছুই না। এর অর্থ শান্তি। রামকৃষ্ণদেব বলছেন, গঙ্গার দিকে যতই যাবে ততই শীতল হাওয়া গায়ে লাগবে, অর্থাৎ শান্তি পাবে।
আজ যে জিনিসটার সব চাইতে অভাব, সে হল শান্তি। শান্তি চাই কি? শান্তির জন্য কি আমি সব ছেড়ে দিতে রাজী? সব ছেড়ে দেওয়া মানে কি? বাইরে থেকে সব? রামকৃষ্ণদেব সাবধান করছেন, বলছেন, দেখো বাড়িতে অশান্তির ভয়ে যে সংসার ছাড়ে সে মর্কট বৈরাগী। সে ভীতু। সে কাপুরুষ। বড় সংসারের ডাক যার ছোটো সংসার ভাসিয়েছে সে অন্য মানুষ। সে কথা অন্য কথা।
সুখের চেয়ে স্বস্তি ভালো। কিন্তু সব সময় সুখ আর স্বস্তি বিরোধী কি? নয়। শান্তির নিজের একটা স্বভাবগত সুখ আছে। আজ যে এত স্ট্রেস নিয়ে কথা হচ্ছে। উঠতে বসতে সবাই বলছে স্ট্রেস কমাও, নইলে হার্ট, কিডনি, নার্ভ, রক্তের রসায়ন সব গড়বড় হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কেউ কি বলছে যে এই স্ট্রেস জিনিসটা আদতে কি? কমবে কিভাবে? চিন্তা করবেন না… আরে মশায় চিন্তা করব না বললেই কি চিন্তা বন্ধ হয়ে যাবে? একি আমার মোবাইলের ফ্লাইট মোড? অন করে দিলেই সব থেকে বিচ্ছিন্ন?
স্ট্রেস মানে আমার মন যখন শান্তিহীন। শান্তি কি পাব কি করে?
প্রথম কথাই হল, শান্তি কি পেতে চাই আদতে? আমার প্রায়োরিটির তালিকাটা আবার শুরু থেকে সাজাতে হবে। আমাকে বুঝতে হবে শান্তি আমার প্রায়োরিটির তালিকায় প্রথমে থাকতে হবে। আমি শান্তিতে থাকলে আমার চারপাশকে শান্তিতে রাখা যাবে। শান্তি সব চাইতে বড় শক্তির উৎস। শান্ত মাথা যত কাজ ঠিকঠিকভাবে করতে পারে, অস্থির, উদ্বিগ্ন মাথা তা পারে না। রামকৃষ্ণদেব বলতেন, ভুড়ি-মুড়ি ঠাণ্ডা রাখবি। মানে মাথা আর পেট ঠাণ্ডা রাখবি। বাঙালি যখন পেটে ঠাণ্ডা রাখার গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা বাহুল্য।
দ্বিতীয় কথা আমায় বুঝতে হবে, শান্তি উপার্জন করা যায় না। শান্তি পরোক্ষ বস্তু। সে নিজে এসে বসে। নিজেকে শান্তি পাওয়ার যোগ্য করে তুলতে হয়। আদিকাল থেকে একই নিয়ম, ত্যাগ ছাড়া শান্তি পাওয়া যায় না। কিন্তু কি ত্যাগ? সংসার, অফিস-কাছারি, ব্যবসা-বাণিজ্য? না। রবীন্দ্রনাথ আর রামকৃষ্ণদেব সহজ করে বলছেন, ছোটো আমিকে ত্যাগ, কাঁচা আমিকে ত্যাগ। ‘ছোটো আমি’ অথবা ‘কাঁচা আমি’ যাই বলো না কেন, সে জীবনকে বিষাক্ত করে তুলছে, বোঝো না কেন? ওকে ত্যাগ করো। রামকৃষ্ণদেব সস্নেহে কেশবচন্দ্র সেনকে বোঝাচ্ছেন। “কেশব কাঁচা আমিকে ত্যাগ করো”। কাঁচা আমি বা ছোটো আমি মানে জেদী, ঘাড়ত্যাঁড়া, ঘ্যানঘেনে, খুঁতখুঁতে, প্যানপেনে, হিংসুটে, লোভী, অবুঝ আমি।
সব শেষে আরেকটা কথা। মজার কথা। শান্তির আশা ত্যাগ না করলেও শান্তি পাওয়া যায় না। কেমন উল্টো কথা হল না? হ্যাঁ, এটা একটা মজার প্যারাডক্স। কিন্তু সত্যি। কেন সত্যি? কারণ শান্তি যদি বাসনার বস্তু তবে ওই কর্পোরেট গুরু, বাড়িতে শান্তিমন্ত্রপাঠ, এই মন্দির, সেই তীর্থ, এই ওই করতে করতে দৌড়াতে দৌড়াতে ঘেমেনেয়ে ক্লান্ত হয়ে যেতে হবে। সেই ক্লান্তকর অবস্থাকে কেউ কেউ শান্তি বলে ভুল করে বসে। ব্যাপারটা আদৌ তা নয়। ‘শান্তি চাই’, বলে হামলিয়ে পড়লে শান্তি পাওয়া যায় না, নিজেকে শান্তি পাওয়ার যোগ্য করে না তুললে। তাই বলছিলাম, শান্তি না চাইলেই আসে শান্তি। শান্তির জন্য কাজ করা, আর শান্তিকে নিয়ে কাজ করার মধ্যে পার্থক্য আছেই। যদি শান্তির জন্য কিছু করতে যাই, নিজেকে ঠকানো হয়। আর যদি শান্তিকে নিয়ে এই সংসারের রণক্ষেত্রে ঢুকি, তবে শান্তি ছেড়ে যায় না। সেই সব চাইতে বড় শক্তির উৎস তখন আমার সে।
শান্তিও দুটো হয়। এক কাঁচা শান্তি, যা আজকাল স্পিরিচুয়্যাল মেটেরিয়ালিজমে বিকোচ্ছে। আর এক খাঁটি শান্তি, যা নিজেকে প্রস্তুত না করলে হবে না। প্রথমটা দুর্বল করে, ভীতু করে, পলায়নমুখী করে। দ্বিতীয়টা শক্তিশালী করে। স্থির করে। সত্য দৃষ্টিতে নিয়ে আসে। রবীন্দ্রনাথ শেখাচ্ছেন, শান্তং শিবম অদ্বৈতম। বলছেন, শান্ত হলেই সংসারে মঙ্গলের বা শিবের দর্শন হবে, তবেই ভেদভাব ঘুচে যাবে। অভয়ে প্রতিষ্ঠা হবে।
নিজেকে বোঝানোর সময় এসেছে… ওহে মন, রিলে, শর্ট ভিডিওতে, সোশ্যাল মিডিয়ার নানা নিউজ ফিডে, ইনফ্লুয়েন্সারে, সেলিব্রিটিতে, ছবিতে, ভিডিওতে, জোক্সে, মিমে, ট্রোলে ইত্যাদি ইত্যাদি কোত্থাও শান্তি নেই কো। ওতে বিক্ষেপ আর বিক্ষেপ। রামকৃষ্ণদেবের ভাষাকে অনুকরণ করে বলি, তুমি সোশ্যাল মিডিয়ায় থাকো ক্ষতি নেই, তোমার মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়া থাকলে বিপদ। (আসল কথাটা ছিল, নৌকা জলে থাকলে ক্ষতি নেই, নৌকায় জল থাকলে বিপদ।)
কোনো শর্টকাট নেই। বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর। শান্তি বিশ্বাসের বস্তু। ঈশ্বরে, ধর্মে বিশ্বাসের কথা বলছি না। সে থাকলেও ভালো, না থাকলেও ক্ষতি নেই। বিশ্বাস মানে, নিজের মধ্যে শান্ত থাকার ক্ষমতায় বিশ্বাস। নইলে বাজার নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরিয়ে মারবে। আমিও ঘুরে মরব। আমায় কোথাও একটা বিশ্বাস করতেই হবে - না, বাজারের থেকে বাইরে আমার এক অস্তিত্ব আছে। লাভ-ক্ষতির বাইরে আমার একটা আমি আছে। যে আমি বিশ্বাসের আমি। আনন্দের আমি। শান্ত, স্নিগ্ধ আমি। তাকে না পেলে সারা পৃথিবীর সবক’টা শপিং মলের মালিকানা পেলেও আমি ব্যর্থ। কারণ আমি শান্তি পাইনি। স্বস্তি পাইনি। চাকা ঘুরুক। শুধু কেন্দ্রের স্থির বিন্দুটা না ছাড়ুক। সেই বিন্দুর নাম ভালোবাসা। বিশ্বাস। আস্থা। জীবন।