সেদিন খাঁচার পাখি আর বনের পাখির মধ্যে তুমুল তর্ক হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের গান কি কবিতা যাই বলুন, আমরা পড়েছি। তাদের মধ্যে যে একটা মিলনের পিয়াস ছিল, তাও পড়েছি। কিন্তু তা হয়নি। বিধাতার মনে কি ছিল সে জানি না, কিন্তু বনের পাখিটার মনে কি হয়েছিল তারপর, বনে ফিরে গিয়ে? তার কি একবারও মনে হয়নি যে খাঁচার পাখি যা বলেছে সে তার প্রাণের কথা নয়? নইলে সে কেন শেষে আক্ষেপ করে বলবে, "হায়, মোর শকতি নাহি উড়িবার!"
মানে তার উড়বার ইচ্ছা ছিল। এতক্ষণ যা বলেছিল সে নিতান্তই তর্কের জন্য। সে তার প্রাণের কথা নয়। বনের পাখির কি মনে হয়েছিল? তার মনে হয়নি সে ফিরে যায়? তার মনে হয়নি তার মৃতপ্রায় ডানায় সঞ্জীবনী সুধা ঢেলে দেয়?
সংসারে ঢুকে এমন খাঁচার পাখি হয়েছে এমন অনেককে দেখেছি। তাদের সারাটা জীবন সমাজ, শাস্ত্র, পারিবারিক আচার, অনুষ্ঠান এমন ঘিরে থেকেছে, সে ভুলেই গেছে তারও একটা ইচ্ছা কোনোদিন ছিল। সে সুখ পেয়েছে, সুরক্ষা পেয়েছে, কিন্তু স্বাধীনতা পায়নি। ডানা যত নির্জীব হয়ে আসে খাঁচা তত সুরক্ষিত, আরামের জায়গা বোধ হতে থাকে। এ স্বাভাবিক। তাই ডানাকে নির্জীব করাকেই আমরা অনুশাসনের নাম দিয়ে চালাই। সমাজের স্থিতি নাকি তাতেই। ডানা নির্জীব হয় শুধু অত্যাচারে যদি বলি, তবু পুরোটা বলা হয় কই? ডানা নির্জীব হয় অতিস্তুতিতেও। আমাদের সে ব্যবস্থাও আছে।
এতদূর পড়তে পড়তে নিশ্চয়ই বোঝা যাচ্ছে আমি সমাজের কোন স্তম্ভের কথা বলছি, হ্যাঁ, আমি মেয়েদের কথাই বলছি। বনের পাখি যদি পুরুষ হয়ে থাকে, তবে কল্পনা করে নেওয়া যেতে পারে খাঁচার পাখিটি নারী।
স্বাধীনতার সঙ্গে অর্থের দিকটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের বাড়ি যিনি কাজ করতেন, একদিন আমায় বলেছিলেন, "দাদা, এই যে আমার শাড়িটা, কি ব্লাউজটা ছিঁড়ে গেলে, কি কোনো কিছু আমার নিজের জন্য লাগলে আমায় কারোর কাছে হাত পাততে হয় না, এ আমার কাছে খুব শান্তির বিষয় একটা। তোমার দাদার কাজ ছিল না, আমিই দাদাকে বললাম, যাও পুজোগণ্ডার দিন, একটা প্যান্ট কিনে নাও তোমার জন্য। দাদা লজ্জা পেল, কিন্তু নিল। এটা ভালো না দাদা?"
হ্যাঁ এটা ভালো। এটাই ভালো। আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়াটা দরকার। আজ লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের অনেক সমালোচনা হতেই পারে। তার সব পয়েন্ট ভিত্তিহীন আমি তাও বলব না। কিন্তু শুধু "দেখ মাত্র পাঁচশো টাকার জন্য দাঁড়িয়েছে..".. "বাপ রে! এই ক'টা টাকার জন্য এত মারামারি! এত লাইন!"....." কি হাড় হাভাতের দল রে বাবা!" এ সব শুনলে আমার মনে হয় এ বিষয়টাকে খুব ছোটো চোখে দেখা। তারা লোভে, মানসিক বিকারে এসে দাঁড়িয়েছে তা তো নয়। অনেকে একে ভিক্ষা হিসাবে দেখেও লজ্জা দিয়েছেন তাদের। অথচ সেই মানুষই গ্যাসের ভর্তুকির কথা শুনে লজ্জা পান না। ডাক্তারি পড়াতে সরকারকে কত টাকা থেকে দিতে হয় জেনে লজ্জা পান না। সরকারি হাস্পাতালে ফ্রি চিকিৎসা নিতে ভিক্ষা মনে হয় না। এমনকি বিশেষ কাস্টের হলে পরীক্ষার টাকায় ছাড় ইত্যাদিকেও ভিক্ষা মনে হয় না। ভিক্ষা কেবল এই টাকার জন্য লাইনে দাঁড়ানোতে?
আসলে মহিলারা এটাকে নিজের অধিকার হিসাবে দেখছেন। পাঁচশো টাকাটা বড় কথা নয়, বড় কথা তার নিজের অর্থ বলতে কিছু তো আছে! যা কারোর অনুগ্রহ না, ভালোবাসার না, দায়বদ্ধতার না, যা শুধু তার, একার তার। ওইটুকুর মধ্যে একটা আত্মসম্মান আছে। তার মানে সরকারের কাছে তার অস্তিত্বের একটা মূল্য আছে। সে যা কিছু করতে পারে সেটা দিয়ে। কারোর কাছে কোনো কৈফিয়ত দিতে হবে না। বাকি সব টাকার জন্য সে কৈফিয়ত দিতে বাধ্য। দিতে না হলেও, দেওয়ার জন্য তাকে তৈরি অন্তত থাকতেই হয়।
আসলে আমাদের মেয়েদের অসুবিধা কিছু তো আছেই। মেয়েদের কাজের জন্য কতটা রাস্তা প্রশস্ত করতে পেরেছি আমরা? ধরুন এক শ্রেণীর মানুষ ঠিকে ঝি, আয়া, হোটেলে রান্না করা --- এরকম নানা কাজ করতে পারেন। আরেক শ্রেণীর মানুষ পড়াশোনা করে একটা চাকরি করতে পারেন। কিন্তু একটা বড় শ্রেণীর মানুষ কোনো কাজেই ঠিক সুযোগ করে উঠতে পারেন না। অবশ্যই মেয়েদের কথা বলছি। সেখানে রিজার্ভেশনের কথা উঠেছে। কিন্তু ক'টা বাড়ির লোক তাদের বাড়ির বউকে সেলসের কাজে, কি জোম্যাটো ইত্যাদিতে বাইকার হিসাবে, কি চট্ করে কোনো দোকানে, শপিং মলে কাজে পাঠাতে চাইবেন? আমাদের কথায় কথায় পরিবারের মানসম্মানে টান পড়ে। আর বাড়ির সম্মান তো মেয়েদের সম্মানের সমার্থক। সেখানে আরো মুশকিল। এ ছবি আগের থেকে বদলেছে। তবে আরো অনেক অনেক বেশি বদলানোর দরকার। সে আমরা সবাই জানি। এখনও আমাদের সমাজে অনেক কাজ "মেয়েদের মানায় না"। এই ছবিটা যেদিন বদলে যাবে সেদিন লক্ষ্মী বলে কোনো শব্দই আলাদা করে খুঁজে পাওয়া যাবে না, তো সে আইডিয়া নিয়ে ভাণ্ডার তো অনেক দূরের কথা।
সবার আগে দরকার আকাশটার পুরোপুরি উন্মুক্তকরণ সবার জন্য। আগে গোটা মাঠটাই খুলে দিয়ে তাদের খেলতে ডাকি, তারপর না হয় তুল্যমূল্য বিচার হবে। তারপর এমন দিন আসবে যখন একজন গর্ভবতী মহিলা সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই জেনে যাবেন যে কন্যা না পুত্র সন্তান হতে চলেছে।
একটা কথা ঠাট্টা করার আগে মনে রাখবেন, আমাদের সমাজে প্রতিটা নারী আত্মগোপন করে অপরাধীর মত জন্মেছেন, যে কোনো মুহূর্তে গর্ভেই নাশ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা নিয়ে। তখনই বুঝতে হবে খুব আশাপ্রদ সমাজে তারা আসেননি। তাই সেখানে যদি তারা কোনো অতিরিক্ত অতি সামান্য প্রাপ্তিকে প্রভূত উল্লাসে উদযাপন করেন, তবে সে লজ্জাটা কার একটু ভাববেন। ব্যস, এইটুকুই বলার। খাঁচার পাখিটাকে প্লিজ যা বলছে বিশ্বাস করবেন না। ওর মুখে, আচরণে বৃহদাংশ আপনার আমার বানানো সমাজ বলে। সে নিজে কতটুকু তার ওই শেষ দীর্ঘশ্বাসটা ছাড়া?