একজন ইন্টারকাস্ট বিয়ে করেছে, সেই অপরাধে তার জগন্নাথ মন্দিরে ঢোকা বারণ। তবু সে ঢুকেছে। তাই বাকি পাণ্ডারা গোঁসা করে শ্রীজগন্নাথ ও তাঁর ভাই-বোনকে সকাল ৮.৩০ থেকে বিকেল ৫.৩০ অবধি অভুক্ত রেখেছেন। ধর্মঘট করেছেন। তারপর মন্দিরের কর্তাব্যক্তিরা এসে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিতে সবাই কাজে ফিরেছে। শাস্ত্রমতে অবশ্যই তার মন্দিরে ঢোকা উচিত হয়নি।
রামমন্দির এখন বড় ইস্যু। শঙ্করাচার্যরা বেঁকে বসেছেন তাঁরা কেউ উপস্থিত থাকবেন না। কারণ সেখানে যা হচ্ছে তা অশাস্ত্রীয়।
আদি শঙ্করাচার্য হিন্দুধর্মের কিছু শাখা প্রশাখা তৈরি করে, কয়েকটা পদ সৃষ্টি করে অরগানাইজড করার চেষ্টা করেছিলেন। ভারতের চার কোণায় চারজন শঙ্করাচার্য থাকবেন। হিন্দুধর্ম অনুয়ায়ী শঙ্করাচার্যদের গুরুত্ব যথেষ্ট।
রিলিজিয়ন আর শাস্ত্রের উৎপত্তিগত একটা মিল আছে। রিলিজিয়ন শব্দটা ল্যাটিন Religare শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ বাঁধা, to bind. শাস্ত্র শব্দটা এসেছে শস ধাতু থেকে, যার অর্থ শাসন করা।
মানুষকে বাঁধা যায় ভয় দেখিয়ে, আর ভালোবাসায়। প্রথমটা মানুষের ক্ষমতার মধ্যে আছে। দ্বিতীয়টা নেই। তাই একদিন রিলিজিয়ন বা শাস্ত্র মানুষকে বেঁধেছিল। আর এখন আইন আর শাস্তির ভয় মানুষকে বাঁধে। যাকে আমরা ডিসিপ্লিন বলি, অনেক অর্থেই সেখানে আমরা মানুষের নিঃশর্ত আনুগত্য দাবী করি। রিলিজিয়ন বা শাস্ত্র সেটাই করতে চেয়েছিল।
প্রশ্ন হল মানুষকে বাঁধার চেষ্টা মানুষ করেছিল কেন? কারণ মানুষের অসীম ক্ষতি করার ক্ষমতা। নিজের ও অন্যের। তাই ক্ষতি করার ক্ষেত্র কমানোর চেষ্টায় ‘'বিধি” আর “নিষেধ” এর রাস্তা বানিয়েছিল মানুষ। যদিও কালের গতিতে সে নিজেই ক্ষতির অস্ত্র হয়ে উঠেছে এও বাস্তব। আসলে যা-ই মানুষ নিজের আওতায় পায় তাকেই সে নিজের ক্ষতি করার ক্ষমতার হাতিয়ার বানিয়ে ফেলে। সে যাই হোক, শিক্ষা থেকে শুরু করে খেলা-রাজনীতি-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি যাই হোক না কেন, তার ক্ষমতা থাকলেই মানুষের সভ্যতায় তার অপব্যবহারের ইতিহাস থাকবেই থাকবে। তাই রিলিজিয়ন বা শাস্ত্রও এর ব্যতিক্রম নয়। আজকের বিশ্বব্যাপী রণংদেহি ছবিও সেই কথারই প্রতিধ্বনি করে। আমাদের সব শিক্ষা ছাপিয়ে নিজের ক্ষতিসাধনের অসীম ক্ষমতার সত্যকে প্রমাণ করে।
রাণী রাসমণি যখন মন্দির বানাতে চান তখনও সেদিকে শাস্ত্রজ্ঞরা “গেল গেল” রব তুলেছিলেন। তারপর শাস্ত্রীয় মধ্যস্থতায় মন্দির তৈরি হয়। শাস্ত্র জয়ী হয়। কিন্তু পূজারী পাওয়া যাচ্ছিল না বলে সেই কামারপুকুর গ্রাম থেকে পূজারীর ব্যবস্থা হল। বাকিটা তো ইতিহাস।
সাধারণ হিন্দু তাই রামমন্দির নিয়ে পড়েছেন ভীষণ বিপাকে। যারা একনিষ্ঠ রাজনীতির ব্যক্তিদের ভক্ত-অনুরাগী তাদের দ্বন্দ্ব নেই। যারা তা নয়, তারা প্রশ্ন তুলছেন, এবার? ওদিকে শঙ্করাচার্যরা ভয় দেখাচ্ছেন দেশে অনর্থ হবে। আসলে ভয়টা শাসনের বা শাস্ত্রের বড় অস্ত্র। আমরা আজও মেনে চলি তাই। আর সেই জন্যেই অফিসে কড়া অফিসার চাই, স্কুলে কড়া হেডস্যার চাই। এই ‘কড়া’ শব্দের আড়ালে যে মনোভাবটাকে ঢাকছি সে মনোভাবটা আদৌ খুব পরিমার্জিত কি? জানি তো, মানুষ সুশিক্ষা, সুনীতিতে চলার জীব নয়। তাকে ‘'কড়া” হাতে শাসন না করলেই সে অনর্থ ঘটাবে।
এর মধ্যে সাধারণ বাঙালি অবশ্য অতটা উৎসাহিত নয়। তার কারণ আমাদের ভাষায় রামচরিতমানস লেখা হয়নি। উত্তর ভারতের তুলসীদাস আর দক্ষিণের ত্যাগরাজের পদে রাম বারবার এসেছেন। কবীর প্রমুখের পদেও এসেছন। সাধারণ মানুষ শাস্ত্র জানে না, কবিতা জানে। গান জানে। আমাদের গানে-কবিতায় কৃষ্ণ আর কালী বারবার এসেছেন, তাই আমাদের সেন্টিমেন্টে তারা আছেন। কিন্তু রাম নেই। যদিও বাংলার ঘরে ঘরে রামমন্দিরে যাওয়ার আমন্ত্রণলিপি বিলি প্রক্রিয়া চলছে, কিন্তু এতে প্রাণ জাগে না। উৎসুকতা জাগে, কৌতুহল জাগে, এত অবধিই। প্রাণ জাগে কবিতায় আর গানে।
ভারতীয় ধর্মের প্রবাহে এ এক আশ্চর্য দিক। আমাদের পথে শাস্ত্রীয় পথ আর মরমীর পথ দুই আছে। এক পরম্পরার বাইরে কিস্যু মানে না। আরেক প্রাণ না ছুঁলে হাঁ বলে না। একটা উদাহরণ নেওয়া যাক। বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী যখন ব্রাহ্মমত ছেড়ে বৈষ্ণব মতে এলেন, শিষ্যের অভাব হল না। কিন্তু গোঁড়া বৈষ্ণবেরা, মানে শাস্ত্রীয় বৈষ্ণবেরা মান্যতা দিল না। কারণ গুরু পরম্পরা নেই।
এখন মরমীর পথ সাধারণের পথ না। সাধারণের ধর্মের পথ শাস্ত্রীয় পথ। গীতা বলছেন কর্তব্য-অকর্তব্য স্থির করতে শাস্ত্রই তোমার প্রমাণ হোক। যদিও সেই গীতাতেই আবার সব ধর্ম ত্যাগ করে হৃদয়স্থিত নারায়ণের শরণাগত হতে বলার উপদেশও আছে। কিন্তু সে ডাকের চাইতে শাস্ত্রের ডাকের উপর ভরসা অনেক। কারণ সে চলা পথ।
আজ শাস্ত্র আর রাজনীতির যে দ্বন্দ্ব এসে দাঁড়িয়েছে তাতে কে জিতবে সে অনুমেয়। দেখা যাক কি হয়। মধ্যস্থতার রাস্তা খুলবে, না উপেক্ষার, সেই দেখার। কিন্তু হিন্দু যে কোনোদিন এক হয়ে ছিল না, অন্তর্দ্বন্দ্ব তার যে আছেই, সে আবার প্রমাণিত হল। সে জাতিবিদ্বেষ হোক, কি শাস্ত্রের সংঘাত। শাস্ত্রীয় সংঘাতে উপায় বলা হচ্ছে মহাজনের রাস্তায় চলা। মহাজন কে? অনুভবে, না ক্ষমতায়?