কুসংস্কার ছাড়া আমাদের আরেকটা সংস্কার আছে, ধ্যাষ্টামো সংস্কার। এদিকে মুখে বলছি মানি না, ওদিকে সব নাকি করা হচ্ছে বাড়ির লোকের তোষণের জন্য, সমাজের জন্য ইত্যাদি।
এদিকে ভোল্টায়ার থেকে লেনিন-মার্ক্স মুখস্থ, তাও ছেলের ঘটা করে পৈতের অনুষ্ঠান দেওয়া হচ্ছে। নইলে নাকি সমাজে থাকা যায় না। আরে আজকাল ধোপা নাপিত তো কেউ বন্ধ করে না। কেউ গা খুলে পৈতেও দেখায় না। তবে?
তারপর গুষ্ঠির পিণ্ডি করে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান। কেন? আপনি তো আত্মা, পরলোক মানেন না। আরে বাবা সমাজ আর পরিবার বলে একটা ব্যাপার আছে না? এ সব করতেই হয়।
কেউ সমাজের দোহাই দেয়, কেউ পরিবারের, কেউ বলে যুগ যুগ ধরে সবাই করে আসছে… ইত্যাদি ইত্যাদি।
এগুলো হল ধ্যাষ্টামো সংস্কার। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এরকম ডাবল স্ট্যাণ্ডার্ড নিয়ে আধসেদ্ধ মন নিয়ে বেঁচে।
কেউ যদি আন্তরিক বিশ্বাস থেকে কিছু করে, সে করুক। সে দণ্ডি কাটুক, ব্রত-উপবাস যা খুশি করুক। কারণ বুঝি। যুক্তি মানুষের বুদ্ধিকে সতেজ করতে পারলেও, ভবিষ্যতের অনিশ্চিতয়তার কাছে যুক্তিবুদ্ধি অনেকাংশেই অসহায়। আজ যেমন দেখছি কোনো এক অভিনেত্রীর জন্য অতিবাম মানুষেরাও 'মিলিত প্রার্থনা' করতে বলছেন। অবশ্যই এও অন্ধবিশ্বাস যদি ঈশ্বরে বিশ্বাস না থাকে তবে। কিন্তু দুর্বল মুহূর্তে এ সব হয়। আমাদের অনেকেরই অভিজ্ঞতা এক। প্রিয়জন সংকটাপন্ন হলে আমাদের অনেকেরই সব গোলমাল হয়ে যায়। সে আলাদা কথা, বুঝি। কিন্তু এটা তো তা নয়।
বাঙালি প্রজাতির বহু ছেলেমেয়েই শুনি "বাড়ির চাপে" আর "মাকে কে দেখবে" এই যুক্তিতে বিয়ে করে। তারপর মা নার্সিংহোমে শ্বাস উঠে "বাবু বাবু" করছেন, আর বাবু বউ নিয়ে জন্মদিনের পার্টি করতে ব্যস্ত, এ সব দেখে দেখেও চুলে পাক ধরে গেল। কিন্তু এই ধ্যাষ্টামোটা আর বন্ধ হল না। আমার অনেক বন্ধু, দাদা, কাকা 'বাড়ির চাপে' বিয়ে করল, যেন বাড়ির সেই চাপটা না থাকলে সব সাধুসন্ত হয়ে হিমালয়ে গিয়ে সেঁধিয়ে বসে থাকত এমন ভাব। আজও দেখি এই প্রজন্মের বেশ কিছু ছেলে একই যুক্তি দেখিয়ে যাচ্ছে। আরে বাবা এখন তো ছোটো বাচ্চারাও বলে না ঠাকুর এসে বাচ্চা দিয়ে গেছে, এখন তো এ সব অপযুক্তি ছাড় রে বাবা!
আমাদের রেলকলোনিতে এক কাকিমা আসতেন, মুড়ি বিক্রি করতে। তা তার বাড়ির সামনে কেউ কার্তিক ফেলে গিয়েছিল। সে কাকিমাকে মা জিজ্ঞাসা করলেন, কি করলেন দিদি?
তিনি বললেন, কেন? তুলসীতলায় বসিয়ে দিয়ে এলাম। আরে আমার বউমাকে নিয়ে মাসে একবার করে গাইনি দেখাতে যেতে হয় দিদি কলকাতায়। বছর দুই হল বাচ্চা হচ্ছে না। সে খরচ কি কম দিদি যে আমি এ আদিখ্যেতা করব? ওতেই যদি হত দিদি তবে ডাক্তারবদ্যি ছেড়ে লোকে কার্তিক পুজো করেই সব কাজ সারত… ঠাকুর মানি দিদি, কিন্তু এসব গাজোয়ারি আমার ভালো লাগে না। আমি কার্তিকঠাকুর তুলসীতলায় বসিয়ে বললাম, এখানেই থাকো বাবা, যারা আমার বাড়ির দরজায় দিয়ে গেছে পারলে তাদের ডেকে তাদের বাড়ি যাও গিয়ে।
আমার এই কথাটা, সেই কাকিমার মুখটা অনেক শিক্ষিত মানুষের ধ্যাষ্টামো সংস্কারের সামনে দাঁড়ালে মনে পড়ে। আসলে একটা জিনিস তো হাড়ে হাড়ে বুঝছি, এই ডাবল ষ্ট্যাণ্ডার্ড, কি আমি যাকে ধ্যাষ্টামো সংস্কার বলছি সে সব স্কুল-কলেজ সিলেবাসের উপর নির্ভর করে না। নইলে শিক্ষিত বাবা-মা কি করে ছেলেমেয়েকে গ্রহণের সময় আজও অনেক বাড়িতে না খাইয়ে রাখে? এরকম অজস্র উদাহরণ আছে। বরং দেখেছি স্কুল-কলেজ যাওয়া অভিমানী মানুষেরাই এই ডাবল ষ্ট্যাণ্ডার্ড আর ধ্যাষ্টামো সংস্কারের পক্ষে অপযুক্তি সাজাতে পারে। সে চালাকিটা তারা শিখে নেয় বেশ। তারপর কপট অসহায়তার হাসি হেসে, হাত কচলিয়ে বলে, "বুঝতেই তো পারছেন"।
সমস্যাটা কি বলুন তো, বৈজ্ঞানিক সত্যটা জেনেও তাকে অস্বীকার করার মত সামাজিক সমর্থন যে সমাজে অনুষ্ঠান করে পালন করা হয়, সে সমাজে এমন ধ্যাষ্টামোটাকে লোকে সামাজিক আচরণ বলে ভুল করে। তাতে মেরুদণ্ডে একটা একটা হাড় দুর্বল হতে থাকে। উপার্জনে, ব্যবসায়, চাকরিতে ক্ষতি কিছু হয় না, কারণ ওখানে ব্যক্তিত্বের চাইতে কৌশলের প্রাধান্য। ক্ষতিটা যেখানে হয় সেটা হল সমাজে শাসক থেকে প্রজা কেউ-ই আর সংকটের সময় বেড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধতে পারে না। হয় বেড়ালটাকেই অস্বীকার করে, নয় বলে ঘন্টাই নেই, বাঁধব কি?
লোকাচারের নামে, সংস্কারের নামে, ঐতিহ্যের নামে যে সত্যনারায়ণকে ক্ষণে ক্ষণে, পদে পদে অস্বীকার করে চলি আমরা, ওতে আমাদের পায়ের বেড়িই শক্ত হয় আরো। নরের অন্তঃস্থলে যে সত্য আচরণে, অনুভবে, বাক্যে প্রকাশিত হবার জন্য উন্মুখ, বৈজ্ঞানিক সত্য আর ভাবগত সত্যের হাত ধরে, সে আর হচ্ছে কই? সত্যনারায়ণ আমাদের ডাবল ষ্ট্যাণ্ডার্ড আর ধ্যাষ্টামো সংস্কারের তলায় তলিয়ে, আমাদের ফাঁকিবাজির উপাদানে গড়া সিন্নিতেই ভাবি তুষ্ট হয়ে যাবেন। ফাঁকি দিয়ে ফাঁকিই পাই আমরা। আর ফলে দুর্বল থেকে দুর্বল হই। তারপর হাত কচলিয়ে, কপট অসহায়ের হাসি হেসে বলি, "বুঝছেন তো সবই"।