Skip to main content

'বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর’ - আজন্ম শোনা কথা। যত বয়েস বাড়ছে তত হেঁয়ালির মত শোনাচ্ছে কথাটা।

মানুষ আজন্ম একা। একাকিত্বের গভীরতায় সে নিজেকে খুঁজে পায়। তাই যখনই মানুষ কিছু খুঁজতে চেয়েছে, সে একা হতে চেয়েছে। নিজেকে খুঁজে পেয়েছে সবার সাথে একটা অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের সূত্রে। যাকে বলা যায় পারস্পরিক নির্ভরশীলতা। বাস্তুতন্ত্র এর সাক্ষ্য দেয় সর্বোচ্চ স্তরে। সে অনেক দূরের তত্ত্ব। সে নিয়ে আলোচনার জন্য লিখতে বসিনি। বসেছি একটা যন্ত্রণা নিয়ে।

আশেপাশের সম্পর্কগুলোতে বড় ভাঙন। বিষণ্ন লাগে। হতাশ লাগে এক একটা সময়। তবু কোনো শাশ্বত সত্যের উপর বিশ্বাস করে দাঁড়িয়ে আবার খুঁজতে শুরু করি পথটা কোন দিকে?
আচ্ছা মানুষের একাকিত্ব যায় কিসে? নাকি একাকিত্বটাই তার স্বাভাবিক অবস্থা? আসলে মানুষ দুটোই চায়। তাকে সুস্থ বাঁচতে গেলে একাকিত্ব আর সাহচর্যর একটা সামঞ্জস্যে নিজেকে দাঁড় করাতে হবে। যেমন গায়ের জামা গায়ের সাথে এক্কেবারে সেঁটে থাকলেও অসুবিধা আবার এক্কেবারে ঢলঢলে হলেও চলে না। কিম্বা বাড়ির ছাদ। মাথায় ঠেকলেও চলে না, আবার আকাশে ঠেকলেও না। আমরা এই দূরত্ব রাখা আর না রাখার একটা সাম্যে আসতে চাইছি সব সময়। পাশের মানুষটার ঘাড়ের উপরও নিশ্বাস ফেলতে চাই না, অথচ তার গায়ের গন্ধটা না পেতে পারি এমন দূরত্বও সয় না।
তবে এত একাকিত্ব কেন আজ চারদিকে? যে একাকিত্ব বাহ্যিক কারণে গড়ে ওঠে তার একটা সান্ত্বনা থাকে কোথাও। কিন্তু যে একাকিত্ব মানসিক কারণে গড়ে ওঠে তা ক্রমশঃ ক্রমশঃ রোগের আকার ধারণ করে, ধীরে ধীরে প্রাণশক্তি অগোচরে শুষে নিতে নিতে, অসময়ে সব শেষ করে দেয় আচমকাই। বাইরে থেকে যতই আচমকা হোক, ভিতরে কি এতটাই আকস্মিক? না তো! এদিকে আত্মহত্যা, নানান জটিল ব্যাধির প্রকোপ বেড়েই চলেছে, বেড়েই চলেছে। যত বাইরের প্রগতি, তত ভিতরে দৈন্যর প্রেতনৃত্য। নিজেকে নিজে এতবড় করে তুলছি যে, সে বৃহৎ সত্তার নির্বান্ধব একাকিত্বের চাপ সহ্য করতে না পেরে, বাস্তব আর অবাস্তব জীবনের ফারাকটুকু মুছে যাচ্ছে বোধের থেকে। কৃত্রিম জগতে, কৃত্রিম সাহচর্যে কালপাত করে চলেছি। কাকে ঠকাচ্ছি?
মানুষ সাহচর্য পায় কিসে? কিসে তার একাকিত্ব দূর হয়?
এর একটাই উত্তর – বিশ্বাসে, আস্থায়। প্রথম আস্থা নিজের উপর। মানুষের নিজের উপর বিশ্বাস থাকলে নিজের কাজের জায়গাটা, এই বিচিত্র সংসারে নিজের ভূমিকাটা স্পষ্ট বুঝতে পারে। সে নিজেকে অবাঞ্ছিত, অপ্রয়োজনীয়, বোঝাস্বরূপ ভাবার অবকাশ পায় না। কিন্তু এতে তার দাঁড়াবার ক্ষমতা জন্মায়, হাঁটার না। তার বর্ণপরিচয় হয়, কিন্তু বাক্যগঠন হয় না।
এরপরের বিশ্বাস ভালোবাসার উপর। ভালোবাসা যদি আস্থার হাত ছেড়ে একা দাঁড়াতে যায় তবে তা বিকার হয়ে ওঠে। গেঁজিয়ে যায়। আজ যত সমস্যা এই ক্ষেত্রটায় এসে। সে বিশ্বাস করতে পারছে না নিজের ভালোবাসার পাশের মানুষটাকে। সব খুব দ্রুত পাল্টে পাল্টে যাচ্ছে। কারোর উপর ভরসা নেই, অথচ পাশে লোকের অভাব নেই। 'Cast Away' নামক একটা ইংরাজী সিনেমা দেখেছিলাম। অত্যন্ত উঁচুদরের সিনেমা। তার যে প্রধান চরিত্র সে একটা বিমান দুর্ঘটনায় একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপে একা বহুকাল কাটাতে বাধ্য হয়। বহুকাল তীব্র জীবন-সংগ্রামে জয়ী হয়ে সে নিজের দেশে দৈবাৎ ফেরার সুযোগ পায়। ফিরে এসে দেখে সব পাল্টে গেছে। একটা চতুষ্কোণ পথের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে সে স্বগতোক্তি করে, 'এই বহু মানুষের মধ্যের একাকিত্ব যেন সেই জঙ্গলের একাকিত্বের চাইতে বহুগুণ যন্ত্রণার!'
তাই হয়। কিন্তু এই বিশ্বাস ছাড়া বাঁচার পথই বা কোথায়? ‘আমার কেউ নেই’... ’আমাকে কেউ পছন্দ করে না’... ’আমি মরি কি বাঁচি তাতে কারোর কিছু এসে যায় না’... এর প্রতিটা কথা সত্য হলেও তা আংশিক সত্য। আমি খেয়াল রাখলে অন্যে খেয়াল রাখে, আমি খোঁজ রাখলে অন্যেও খোঁজ রাখে, আমি পাশে দাঁড়ালে অন্যেও পাশে দাঁড়ায়। হয় তো হিসাবে বরাবর হয় না সবসময়, তবু নিজের মধ্যে বিশ্বাসটুকু জাগিয়ে রাখার কাজটা নিজেকেই করতে হবে। নিশ্চই হতাশ হওয়ার মত বহু ঘটনা ঘটছে চারদিকে, নিশ্চই অনাস্থা বৃদ্ধির হারটা তীব্র হয়ে উঠছে দিন দিন, তবু...

হ্যাঁ এই ‘তবু’ ছাড়া গতি নেই। নিজের গদির থেকে নামতেই হবে। নিজের ধ্যানধারণা যা কিছু নঞর্থক তাকে পাশ কাটাতেই হবে, অস্বীকার না করতে পারলেও। সবার মাঝে গিয়ে মিলতে হবে। ফিল্মী কায়দার ‘আমি তোমার আর তুমি আমার’ ছাড়াও সংসারে অনেকরকম সম্পর্ক আছে, যেগুলোতে নিজের প্রাণশক্তির অপচয় হয় না নিজেকে সম্পূর্ণ সঁপে দিলে। মানুষ সবচাইতে বেশি খুশী হয় নিজেকে ভুলতে পারলে। আমি যাকে চাই তার হয় তো আমাকে প্রয়োজন নেই, নাই বা থাকল। চারপাশের সব ক'টা দরজা খুলে দেখি, কারোর নিশ্চই প্রয়োজন আছে আমাকে। এই খোঁজেই সমাজের শিরায়, ধমনীতে রক্ত ছোটে। আমার প্রয়োজন ভালোবাসার লোক, কারোর প্রয়োজন ভালোবাসার হাত। এই খোঁজই অনাথ আশ্রম থেকে শুরু করে নানান সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে অথবা সমাজের নানান আরো ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ পরিসরে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। মাদার টেরেসা বলতেন, 'কুষ্ঠ, টিবি ইত্যাদি ভয়ংকর রোগ না, ভয়ংকর রোগটা হল সবার কাছেই অবাঞ্ছিত হওয়ার অনুভব।'

এই বোধটা থেকে উত্তরণের পথই ধর্ম। ক্ষুদ্র সংসার থেকে উত্তরণের জন্য তীব্র যন্ত্রণা। সেই বিচ্ছিন্নতার যন্ত্রণায় হেরে না গিয়ে নিজেকে বিশ্বসংসারের ডাকে সাড়া দেওয়ার উপযুক্ত বোধ করা। আর এই বোধের জন্য গভীরে থাকা বিশ্বাস।
"আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া
বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া"