Skip to main content
 
 
 
 
 
সেদিন থেকে তিনটে বুলেট উপড়ানোর কাজ শুরু হল। কেউ করল স্তব, কেউ করল সমালোচনা। কেউ মাথা নীচু করল কৃতজ্ঞতায়, কেউ করল অভিযোগের পর অভিযোগ। কিন্তু এরা কেউ বুলেট উপড়ানোর কাজ থামায়নি। দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ছুটে, হেঁটে বলতে লাগল, বুলেট তুলে ফেলো... বুলেট.... শান্তি প্রতিষ্ঠা করো.... সাম্য....
       ক্রমে এই ডাক এই তিনকোণা মাটির দেশ ছেড়ে গেল পুরো গোল পৃথিবীটার সাথে মিশে, নানা দেশে দেশে। সবাই বলল, বুলেটটা তোলো, বুলেট। শুধুমাত্র বসে বসে নিন্দা-স্তবে কিচ্ছু আসবে যাবে না মানুষটার। শোনোনি সে বিশ্বাস করে, "তুল্যনিন্দাস্তুতির্মৌনি", গীতার কথা - স্তুতি-নিন্দা যার কাছে সমান, যে মৌন দুয়েতেই। গীতাকে সে মা বলে, বলে, গীতা মাথার কাছে রেখে শুই, বলে, যখনই কোনো সংশয়ে ভুগি গীতার কাছে দাঁড়াই, উত্তর পাই। সে মানুষটার কাছে কিসের স্তবস্তুতি। কিন্তু বলো, তবু সে হিন্দু হতে পারল না ওদের কাছে। তাদের মনে হল সে হিন্দু কই, সে তো মুসলমানেদের বেশি তোষামোদ করে। বোঝো! ভালোবাসা ছাড়া শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায় বুঝি? আচ্ছা বলো, বুদ্ধ বলল, ঘৃণার দ্বারা ঘৃণার উপশম হয় না। এ কথা কি স্লোগান? এ তো বিশ্বাসের কথা। মানুষ যে কথা শুধুই শোনাতে চায়, শুধুই মানাতে চায়, সে কথাকে সে স্লোগান বলে। কিন্তু যে কথাকে সে প্রাণের সাথে বিশ্বাস করে, সে কি স্লোগান হয় গো? তাই মানুষটা স্লোগান দিতে পারত না। প্রার্থনা করতে পার‍ত। হাঁটতে পারত। বুক পেতে দিতে পারত। মানুষটা সেই বহুযুগ আগে জেরুজালেমে জন্মানো একটা বোকা মানুষকে বেবাক ভালোবেসেছিল। সে জেরুজালেমের লোকটার একটা ব্যামো ছিল, সে শত্রু মিত্র চিনতে পারত না। সে বলত, যে তোমায় ভালোবাসে শুধু যদি তাকেই ভালোবাসো তবে তো তুমি ব্যবসায়ী, সে তো শুধুই লাভের দিকে তাকায়, যে শুধুই যে তার ঋণ চুকিয়ে দেয় তাকেই ভালোবাসে। বরং যেখানে তোমার অপমান, যেখানে তোমার জীবন বিপন্ন হতে পারে, তেমনভাবে ভালোবাসো। কি বাজে, অকাজের কথা না? হুম তো, কিন্তু এই বোকা লোকটা এই কথাগুলো সেই ক্রুশে ওঠা অবধি বিশ্বাস করে ছাড়ল, আর এই মানুষটা গুলি খাওয়া অবধি।
       আসলে ওই জেরুজালেমের লোকটা আর এই পোরবন্দরের মানুষটার সমস্যা হল, পৃথিবীতে মানুষকে দিয়ে নানা কাজ করিয়ে নেওয়ার যে হাজার একটা কৌশল আছে সে তারা বিশ্বাসই করত না। সেই কি একটা শব্দ, ভালোবাসা, হিংসা না করা, সেই কথাতেই খেত, শুতো, নাইত, বেড়াত। বলত, শান্তি প্রতিষ্ঠা করো, নিজের মধ্যে, দেশের মধ্যে। কি ভাবে? হিংসা না করে, নিজেকে বিপন্ন করে। এইখানে যত মুশকিল হল জানো, আমায় বিপন্ন করার জন্য ঘরে বাইরে মানুষের অভাব নেই, কিন্তু কেউ যখন আমার জন্য নিজেকে বিপন্ন করে ফেলে তাকে নিয়ে হাজার একটা সমস্যা। তাকে এড়িয়ে চলা যায় না। তাকে ভুল বোঝানো যায় না। তার উপর অভিমান হয়। আস্থা ছাড়া অভিমান হয় না আস্থা ছাড়া আক্রোশ হয়। কিন্তু এ মানুষটাকে শত্রু ভাবলেও আস্থা রাখা যায়, এ কিরকম সমীকরণ বলো? কিন্তু তাই, তাই, তাই হল যে বারবার।
       কিন্তু আজ কিছু মানুষ যে আবার তাকে খুঁজছে গো। আবার লুকিয়ে বন্দুক এনেছে। বলছে আমাদের দেগে দেওয়া বুলেট ওই মানুষটার বুক থেকে কে তুলতে বলেছে? ওরা টের পেয়েছে আমাদের মধ্যে ওই পোরবন্দের মানুষটা এখনও কানে কানে বলে, কেন কোরাণ গীতা বাইবেল ধম্মপদ গুরুগ্রন্থ আলাদা করবে, কেন বলবে না, এক রাম তার হাজার নাম, কেন জানবে না ঈশ্বরের কোনো ধর্ম নেই, কেন জানবে না সত্যই ঈশ্বর?
       এইসব কথায় কারা যেন শিউরে শিউরে উঠছে আজ। বলছে, ওরা শত্রু!
       এই বলে তারা হিংসাকে রাজার আসনে বসাচ্ছে। হিংসার বদলে হিংসা - এই নীতি বলতে চাইছে। জেরুজালেমের লোকটা বলেছিল, চোখের বদলে চোখ হলে গোটা বিশ্ব একদিন অন্ধ হয়ে যাবে। পোরবন্দরে মানুষটা বলেছিল, তাই তো। এরা বলছে, হোক অন্ধ, আমরা তো আছি! বোঝো! অন্ধকে নাকি অন্ধরা পথ দেখাবে!
       শত্রু বানানোর কারখানা বাঁধা হচ্ছে। খোঁজো কে শত্রু। বেদ-উপনিষদ-রামায়ণ-মহাভারত সব স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে। বলছে, কে শেখালো এ ধর্ম? আমরা কি বলিনি বসুধৈবকুটুম্বকম?
       এরা গলা চড়িয়ে বলছে, তাতে কি আমরা বারবার আক্রান্ত হইনি?
       পুরাণের ঋষি বলছেন, কিন্তু সে আঘাত তো শরীরের? আমরা কি বলিনি আত্মা অমর? আমরা কি বলিনি সহ্য মহতের ধর্ম? আমরা কি বলিনি উদারতা আত্মার স্বভাব?
       তারা বলেছে, কিন্তু আমাদের কি আজ অস্তিত্ব-সংকট নয়?
       না। শিকাগো থেকে ফিরে আসা সে ছেলেটা একবার হিমালয়ের এক বিধ্বস্ত মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিল,"মন্দিরের একি অবস্থা মা? আমি ঠিক করে দেব।" জানিস কি শুনেছিল সে? সে শুনেছিল, মা যেন বলছেন, "তুই আমায় রক্ষা করিস না আমি তোকে রক্ষা করি?" ছেলেটা লজ্জা পেয়েছিল।
       ঋষি বললেন, যদি রাজার আসনে বসেছিস, তবে লজ্জার কারণ হোস না, গর্বের কারণ হ।
       আজ সে বুলেট তোলার দিন। যেখানে যতটা হয়। সেতু বাঁধতে তো কাঠবেড়ালিও এসেছিল। আজ সে কাজে হাত লাগাতেই হবে।