Skip to main content

        দর্শন শুষ্ক, অনেকে বলেন। যদিও আমার কাছে আজ অবধি তা মনে হয়নি কখনও। নিজেকে জানার, নিজের বাইরে ভিতরে আসা যাওয়া করার এর থেকে ভালো পথ আর দেখি না। প্রতিটা অনুভবের একটা ছায়া থাকে। সে ছায়ার থেকে সরে দাঁড়িয়ে যদি কিছুক্ষণ নিবিষ্ট চিত্তে সেই ছায়ার দিকে তাকিয়ে থাকা যায়, তবে মনে হয় সেই ছায়াটার মধ্যে নিজের একটা আলগা পরিচয় পাওয়া যায়। পরিচয়টা আলগাই অবশ্য। এরকম কোনো একটা ছায়া নিয়ে একটা কবিতা জন্মায়। কখনও সেই ছায়ারা একটা বিরাট সাম্রাজ্য তৈরি করে একটা উপন্যাস বানায়। কয়েকটা ছায়া জুড়ে জুড়ে গল্প বানায়। যাই বানাক, আদতে সে সেই ছায়া। সেই ছায়ার পর্যবেক্ষণকারী যে, তারও একটা ছায়া সেই পর্যবেক্ষণের মুহূর্তে তৈরি হয়, কিন্তু সেটা সেই সময়ের জন্য থেকে যায় তার অগোচরে। সেটাকে বাস্তবে আনা সেই মুহূর্তে তার কোনোদিনই সম্ভব নয়। সেইখানেই তার নিজের অস্তিত্বের রহস্য। 
        মানুষ যেন দুটো প্রকাণ্ড পাঁচিলের মধ্যে একটা সরু পথ দিয়ে চলেছে, তার আগুপিছু অন্ধকার। সে একটু ডানদিক বাঁদিক সরতে গেলেই তার পাঁচিলের সাথে ধাক্কা, সামনের দিকে তাকে এগোতেই হচ্ছে, কিন্তু সেই এগোনোর কোনো দিশা সে যেন পাচ্ছে না, কারণ ঘুটঘুটে অন্ধকার। তখন তার মধ্যে একটাই উপায় - বিশ্বাস। যার উপচ্ছায়া তার কল্পনা। 
        মানুষ বিশ্বাস ছাড়া কল্পনা করতে পারে না। প্রতিটা কল্পনাই জন্মায় কোনো না কোনো বিশ্বাস থেকেই। এই বিশ্বাস আর কল্পনা না থাকলে, মানুষের এই সরু অন্ধকার গলিটায় চলাফেরা করাটা কিছুতেই হয়ে উঠতে পারে না। সেই কল্পনাকেই সে নিজের প্রেরণা বলে, পরিচয় বলে। যদিও কোনো বিশ্বাসই তার কাছে চিরস্থায়ী নয়, তবু একটা না একটা বিশ্বাস সে বানিয়েই চলতে থাকে। 'আমি কোনো কিছুতেই বিশ্বাস করি না' যখন কেউ বলে - সেও এক ধরণের বিশ্বাস থেকেই বলে। তার নাম সিনিজিম, নিহিলিজম ইত্যাদি যাই দিই না কেন, সবই আদতে বিশ্বাস। 
        বিশ্বাস আর জানা - এদের মধ্যে একটা প্রকৃতিগত মিল থাকেই। যে মানুষটা যে ধরণের বিশ্বাসী সে সেই ধরণের কিছুই জানতে চায়। জানা আর বিশ্বাসের মধ্যে যখন বিরোধীতা হয়ে থাকে, তখন সে বিশ্বাসটাকে বদলে নেয় তার সেই জানার অনুরূপ করে। যেমন আমি দিল্লী যাওয়ার আগে একটা বিশ্বাস নিয়ে পৌঁছালাম, তারপর সেখানে গিয়ে আমার জানাটা যেই আমার বিশ্বাসের সাথে বিরোধীতায় গেলো, আমি অমনি তখন আমার বিশ্বাসের ধারাটা বদলে নিলাম। আবার আমার কল্পনার ধারা বদলে গেল। তা যে সব সময় সুখকর হয়ে উঠবে তা তো নয়, সে খুব একটা উৎকণ্ঠাজনকও হয়ে উঠতে পারে। আর যারা সে বিশ্বাসটাকে বদলাতে চাইল না তারা নিজেদের মধ্যে বিভক্ত হয়ে নিজেকে আরো বেশি অস্পষ্ট করে নিজের সুস্থ থাকার ক্ষমতাটাকে দুর্বল করে তুলল। 
        এইখানেই আমাদের আজকের দিনের সমস্যা। আমাদের পূর্বপুরুষদের একটা বিশ্বাস ছিল, একটা জীবনশৈলী ছিল, যা অনেকটা একটা ঐতিহ্য আর বিশ্বাসের প্রতি তার আনুগত্য রেখে চলত। কিন্তু আমাদের জানাটার বেগ এখন এতবেশি যে আমাদের বিশ্বাস ঠিক তার সাথে তাল মিলিয়ে নিজেকে বদলে নিতে পেরে উঠছে না। আমরা একটা তত্ত্ব পড়ি উদ্ভিদবিদ্যায়। কোনো কোনো গাছের উপরিতলে একটা মোমের আস্তরণ থাকে, যা জড়। এখন হয় কি, উদ্ভিদের উপরিতলের সজীব কোষগুচ্ছেরা এত তাড়াতাড়ি বেড়ে ওঠে যে সেই মোমের আবরণ তার সাথে তাল রাখতে না পেরে যায় ফেটে ফেটে। আমাদের বিশ্বাসের হয়েছে আজ সেই দৈন্যদশা। সে কি করবে, কোন দিকে ফিরবে, কোন দিকে তার নিশ্চিন্ততা সে যেন কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না। তাই যা পাচ্ছে তাকেই বলে উঠছে, আরে এটাই আমাদের দেশের আদর্শ ছিল, এটাই ভারতীয় সংস্কৃতি, এটাই আমাদের ঐতিহ্য ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব বলতে বলতে যত তার নিজের মধ্যে নিজের দুর্বলতাটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে সে তত জোরে চীৎকার করে সেই দুর্বলতার মাথায় বাড়ি মেরে বলতে চাইছে, আমি এটাই... আমি এটাই... আমি এটাই... 
        এই সমস্যা একটা কালের কালের সমস্যা। একজন মানুষ যেমন ব্যক্তিগত, তেমনই সে একটা সময়গতও। একটা সভ্যতাও তাই। এখন এই অস্পষ্টতার মধ্যে সে নিজের বিশ্বাসের পিঁড়িটা খুঁজে বেড়াচ্ছে যে একটু হাত পা ছড়িয়ে বসবে। কিন্তু সে পিঁড়ি আর পাওয়া যাচ্ছে না। সে রেগেমেগে একবার মাটিতে বসছে, একবার গাছের ডালে বসছে, একবার নদীর ঢেউয়ে চড়ে বসতে চাইছে, কিন্তু কিছুতেই কিছু একটা হয়ে উঠছে না। 
        তবু বিশ্বাসটাকে খুঁজে পাওয়া দরকার। এ বিশ্বাস কেউ কাউকে খুঁজে দেয় না, নিজেকেই খুঁজে নিতে হয়, কিন্তু এই বিশ্বাসটাকে খুঁজে নিতেই হয়। কিন্তু এর একটা কিন্তুও আছে। যা জানি সেই কি পরম?
        না। যা প্রাথমিকভাবে জানি, তা আপাত। তাকে আরো গভীরে গিয়ে জানতে হলে আমাকে সেই ছায়াদের সামনে দাঁড়াতে হবে, যতটা নিরপেক্ষ হয়ে দাঁড়ানো যায়। সেই ছায়াদের পর্যবেক্ষণ করতে করতে একটা বোধ জন্মায়। সেই বোধটাকে দিনের আলোয় নিয়ে এসে, অনেকের সামনে রেখে পরীক্ষা করে দেখতে হয় সেই বোধের বাস্তবতা কতটা। সেই থেকে শুরু হয় একটা নতুন কৃষ্টির। সে কৃষ্টি সচল, জীবন্ত। সে জানার পাশে এসে বসে। জানার অপূর্ণতা পূরণ করে নতুন সজাগ কল্পনায়। তাতে ঘোর তৈরি হয় না, তাতে সময়ের সাথে আবার একটা নতুন সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাকেই আমরা বলি নবজাগরণ। নতুন বিশ্বাস।