Skip to main content

        ভারত একদিন বুঝেছিল, শাস্ত্র আর হোলিবুকের মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। শাস্ত্র যা শাসন করে, যাকে শুধু শুদ্ধ, পবিত্র বলে মেনে চললেই হয় না, প্রয়োজনে তাকে প্রশ্ন করাও যেতে পারে। এই প্রশ্ন করা, ক্রিটিকালি দেখার প্রচেষ্টা নিয়ে ভারতের দর্শন এগিয়েছে বলেই, ভারতে ধর্মগ্রন্থ আর দর্শন গ্রন্থ কাছাকাছি এসে পড়েছে। যদিও পাশ্চাত্য মতে যা দর্শন তা ভারতে সে অর্থে নেই, এখানে অতীয়ন্দ্রিয়বাদ নির্ভরতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত নয় দর্শন। তবু একটা প্রশ্নের জায়গা প্রাচীন ভারতে ছিল। 
        এ কথাটা এই জন্যে বলা, বেশ কিছুদিন আর বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ, বহুবিবাহ সংক্রান্ত যুক্তিগুলো পড়তে পড়তে দেখছিলাম কিরকম ভাবে তিনি একটার পর একটা শাস্ত্রীয় উদ্ধৃতি দিয়ে নিজের মত প্রতিষ্ঠা করে চলেছেন। কোনো পাশ্চাত্য দর্শনের উল্লেখ নেই সেখানে। ইদানীং দুদিন ধরে পড়লাম রামমোহন রায়ের সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা কলমের ভাষ্য। ভাবতে অবাক লাগছে, "আপনি এরকম একটা বহু বছর ধরে চলে আসা প্রথার বিরুদ্ধে বলছেন কেন?” - এমন একটা বাক্যবন্ধ দিয়ে শুরু হচ্ছে সেই তর্ক। অর্থাৎ একটা মানুষকে জলজ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হচ্ছে, তার প্রতিবাদের অভিসন্ধি খুঁজতেও মানুষের বেগ পেতে হচ্ছে না। মানুষের অন্ধত্ব কোথাও পৌঁছালে এমনটা সম্ভব ভাবতে বাকরোধ অবস্থা হয়। 
        কলকাতায় এসে কেউ যদি মিউজিয়ামকেই গোটা কলকাতা জেনে বসে থাকে, কেউ যদি এস্প্ল্যানেডকেই শুধু কলকাতা জেনে বসে থাকে, তবে তাতে তার নিষ্ঠা, তার একাগ্রতা, তার ভক্তির প্রশংসা করার উপযুক্ত ক্ষেত্র মেলে বটে, কিন্তু তার সংকীর্ণতার কথাটা উহ্য থেকে যায়। তারপর একদিন মনুমেন্টের ভক্তের সাথে মিউজিয়ামের ভক্তের, এস্প্ল্যানেডের ভক্তের সাথে চিড়িয়াখানার ভক্তের বিরোধ বেধে যায়। কারণ সবাই জানে তাদের পূজ্য বস্তুটিই হল পুরো কলকাতা। এই পুরো কথাটা থেকেই যত গোল। এক মতে হোলি শব্দটা হোল অর্থাৎ সম্পূর্ণ শব্দটা থেকে জন্মেছে। আজ অবধি আদর্শগত যা কিছু বিরোধ, এই শব্দটা থেকেই তার সূত্রপাত। এ বলে এ সম্পূর্ণ, সে বলে সে। 
        জিবরান বলেন, কখনও বোলো না তুমি সত্যকে জেনেছ, বলো, তুমি একটা সত্যকে জেনেছ। জিবরান বলেন, তোমার খোলা জানলার আকাশের চাইতে আকাশ অনেক বড়ো, মনে রেখো। আমাদের এখানেও সে গোল শুরু হল তখন যখন শাস্ত্রের উল্লিখিত সত্যের চাইতে শাস্ত্রের অক্ষরমালা বড় হয়ে উঠল, চরিত্রের চাইতে মানুষটা বড় হয়ে উঠল। তখন পূজোতে শুধু অন্ধতার দাপট, অনুকরণের দাপট। অনুসন্ধিৎসা অন্তর্হিত। হৃদয়ের একটা বৌদ্ধিক অনুসন্ধিৎসা আছে। যার মিলিত ফল, বোধ। সে বোধের আলোয় জ্বলে বিবেক। মানুষের জাগ্রত চিত্ত কোনোদিন তৃপ্ত হতে পারে না। যদি সে তৃপ্ত হয়, সে মৃত। তুলসীদাসের কথায় আছে, ভরউ নিরন্তর হোয়ে না পুরে, সে কোনোদিন পরিপূর্ণ হয় না। সে তৃষ্ণার জোরেই মানুষের সমাজ, বিজ্ঞান, অর্থনীতি, দর্শন, রাজনীতি।
        বেদান্ত দর্শনে এই কথাগুলোর আভাস আছে। সেখানে একটা বড় সত্যের দিকে এগোবার কথা বলা আছে। সোশ্যালিস্টের সমাজ আর বেদান্তের ব্রহ্ম অবস্থান খুব একটা দূরত্বে নেই। আত্মা বলতে যে অতীয়ন্দ্রিয়তার দিকে ঝোঁক বোঝায় তাকেও নস্যাৎ করে বেদান্ত বলে অল্পে সুখ নেই, সমগ্রতে সুখ। অর্থাৎ তুমি কাউকে সমগ্র বলে থেমে থেকো না, নিজের মধ্যে সমগ্রের আসার জায়গা করে দাও, তুমি নিজে বড় হও। যীশুর ভাষায়, পিতার মত উদার হও। রামমোহনের খ্রীষ্টকে আবিষ্কার আর বেদান্তকে চেনা এই বড় ক্ষেত্রের উপর দাঁড়িয়ে। রবীন্দ্রনাথের উদার শিক্ষানীতি এই বেদান্তের উপর দাঁড়িয়ে। মানুষের মধ্যে যে একটা বড় আসন পাতা আছে, তার মধ্যে যে একজন বড় মানুষ আসার কথা আছে সে কথা লালনের মনের মানুষেও আভাস পেয়েছিল ভারত, রবীন্দ্রনাথ মুগ্ধ হয়েছিলেন বাউলের গানে। কিন্তু মোদ্দা কথাটা সেই সঙ্কীর্ণতার ঊর্দ্ধে ওঠার চেষ্টা। যে তাগিদটা তার মধ্যে আছেই। 
        আজ আবার সে কথা ভোলার চেষ্টা হয়েছে। আধুনিক যুগের সবচাইতে বড় বেদান্তের ভাষ্যকার বিবেকান্দের উদার বেদান্ত দর্শন রামকৃষ্ণের অবতারবরিষ্ঠায় মন্ত্রে আবার নতুন করে সঙ্কীর্ণতা তৈরি করে দলাদলির সূত্রপাত করে বসেছে। ভারতে একের পর এক গুরু, একের পর এক সম্প্রদায় আবার সেই 'আলোকে ভরা উদার ত্রিভুবন' এর উপর ঢাকনা দিচ্ছে। কথাটা আস্তিকতা বা নাস্তিকতা না, কথাটা সঙ্কীর্ণতার। কোনো মানুষই তার বিশ্বাসের গুণে বড় হয়নি, হয়েছে সেই বিশ্বাসের উদার প্রয়োগের মাহাত্ম্যে। সে ইডা স্কাডারের ভেলোর হাস্পাতাল প্রতিষ্ঠাই হোক, গান্ধীর রামই হোক, আর রবীন্দ্রনাথের ঔপনিষদক ব্রহ্মই হোন, - এরা কেউ সংকীর্ণ নয়, এই হল মূল কথা। আজ শবরীমালা থেকে প্রস্তরমূর্তি, নামকরণ সবই বিশ্বাস করাতে চাইছে ছোটো, স্পষ্ট কথাটাই শেষ কথা, কিন্তু তা নয়। এ যুগের এক প্রধান দার্শনিক রামকৃষ্ণের অনুভবে, গেড়িগুগলি ডোবাতেই বাসা বাধে। 'সাগরে যার বিছানা মা, শিশিরে তার কি করিবে'। ঢাকনাটা সরাতেই হবে।