দিল্লী থেকে ফিরছি, ট্রেনে খুব অসুস্থ হয়ে পড়লাম। বেড়াতে গিয়েছিলাম বন্ধুরা সবাই, সঙ্গে কয়েকজন বন্ধুর পরিবারের লোকেরাও ছিলেন। দুরন্ত এক্সপ্রেস। থামার জায়গা কম। বন্ধুরা বেশ একটু উদ্বিগ্ন, কি হবে আমার এই নিয়ে। যা হোক রাতের দিকে সুস্থ হতে শুরু করলাম।
রাত তখন ক'টা মনে নেই, আমার ঘুম আসছে না, নীচের বার্থে শুয়ে বাইরে তাকিয়ে। অন্ধকার চারদিক। মনটা বড় উদাস হয়ে গেল। জীবনে সব চাইতে মূল্যবান কি? আমি এখানে অল্প একটু লেখালেখি করি। কিছু মানুষ ভালোবাসেন। কিছু মানুষ চেনেন। পড়াই, সেখানেও কিছু পরিচিতি আছে। এইগুলোই কি জীবনের সম্পদ? মন বলল, না। এগুলো না হলেও আমার জীবন দিব্যি চলে যেত। চলে যায়। কিন্তু যা না হলে চলে না সে হল আমার আশেপাশের মানুষজনেরা। আপনাদেরও নিশ্চয় তাই। দেখুন, একটা ফুলগাছে ফুল হবে, সেটাই স্বাভাবিক। সে ফুল নিয়ে হাটে এলে কেউ পছন্দ করবে, কেউ করবে না --- এও স্বাভাবিক। কিন্তু যে গাছটায় ফুলটা ধরল, সে গাছটা কি শুধুই ফুল? তার কি এমন মরশুম আসে না, যে সময়টায় তার ফুল ধরে না। কিম্বা ফুল হয় না এমন গাছও তো আছে। কিন্তু সে গাছেরও পরিচর্যা লাগে। আগাছারও পরিচর্যার ভার নেয় প্রকৃতি। কিন্তু মানুষের বেলায় তা হয় না। মানুষকে আগাছা বানাতে চাইলেও সে আগাছা হয় না। সে মানুষই থাকে। তার পরিচর্যা লাগে। খুব লাগে। আমরা প্রত্যেকেই একে অন্যের প্রত্যক্ষ পরোক্ষ পরিচর্যায় বেঁচে থাকি। যদি কোনো মানুষ অবহেলায় মারা যায়, তাকে আমরা তাই শুধু দুর্ঘটনা বলে এড়িয়ে যাই না, তাকে আমরা আমাদের সামাজিক লজ্জাও বলি। সমাজ মানেও আমি। এমন দরদী মানুষও আছেন, যিনি একটা পথের কুকুর অবহেলায় মারা যেতে বসেছে দেখলে তার আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেন। কারণ এই পারস্পরিক পরিচর্যাতেই জীবন ছন্দ পায়।
আমার বাড়িতে দু'জন বয়স্ক মানুষ আছেন, আমি ছাড়া। আমার বাবা আর আমার জেঠিমা। মা নেই, জেঠুও নেই। আমি যখন ওদের কাছাকাছি বসি, বিশেষ করে ওদের খাওয়ার সময়, মাঝে মাঝে কান্না পেয়ে যায় ওদের চোখের শূন্যতা, অসহায়তা দেখে। প্রায়ই অন্যমনস্ক হয়ে যান, বাবা মায়ের কথা বলেন, জেঠিমা জেঠুর কথা, আমার মায়ের কথা, ঠাকুমার কথা বলেন। আমি চুপ করে শুনি। যখন প্রচণ্ড বৃষ্টি, বাবা নিজের ঘর ছেড়ে বেরোতে পারেন না, টিভিও চলছে না, বা মোবাইলও চালাতে পারছেন না, একা ছাদের দিকে তাকিয়ে শুয়ে আছেন, আমি ঢুকলে চমকে অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন। আমি বুঝি আমি ওনার স্মৃতির যাত্রায় হুট করে ঢুকে পড়েছি। কথা খুঁজে আমিও পাই না, উনিও পান না। কিছুক্ষণের জন্য, আবার সব কেটে যায়, স্বাভাবিক কথার ছন্দ খুঁজি। কিন্তু সত্যি বলতে, পারি না। এই দু'জন জীবনসঙ্গী হারানো মানুষের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন আজও আমার স্বাভাবিকভাবে হল কই? অতটা যন্ত্রণা আমার প্রাণে কই? বাবা ও জেঠিমা পুরোনো ভাবধারায় বিশ্বাসী। বাবা দোতলায় থাকেন, জেঠিমা একতলায়। কদাচিৎ দু'জনের সঙ্গে কথা হয়। সেও খুব ফর্ম্যাল। দু'জনেই দু'জনের অতীতের প্রসঙ্গ তোলেন না। টিভিতে ঠিক ছবি আসছে কিনা, গরম পড়েছে কিনা, এসি চালালে ঠাণ্ডা লাগবে কিনা --- ইত্যাদি প্রসঙ্গের বাইরে কথাই হয় না। এমনকি দু'জনে দু'জনের চোখের দিকে তাকিয়েও কথা বলেন না। এক একদিন এমন হয় আমরা তিনজনে তিনজনের ঘরে, কেউ কাউকে ডাকছি না। আমি দূর থেকে গিয়ে দেখে আসি ঠিক আছেন কিনা। কিন্তু কথা বলা হয় না, ওনারা একা একা যে রাজ্যে থাকেন, সেখানে আমি কই? দু'জনে যে পরিচর্যার দু'জনকে খুঁজছেন, তারা অন্য পারে। বাবা আর জেঠিমার কাছে নিঃশব্দে বসলে বুঝতে পারি, মৃত্যু কত পাতলা একটা আড়াল। স্মৃতিরও একটা পরিচর্যা আছে। আত্মাকে শান্ত করে যা।
রাস্তাঘাটে যে মানুষগুলোকে দেখেছি, খেয়াল করলে দেখবেন সেখানেও পরিচর্যা আছে। পর্যাপ্ত না হলেও আছে। উত্তরপাড়া স্টেশানে বসে আছি। চায়ের দোকানে এসে একজন ভিখারি তার পোঁটলা বুকে নিয়ে হাত বাড়ালো। দোকানি একটা চা ভর্তি ভাঁড় এগিয়ে দিয়ে বলল, ক'দিন আসোনি কেন? বুড়ি বলল, জ্বর এসেছিল। সেই কথাটা শুনে চায়ের দোকানের লোক একটা কেক বার করে বলল, খেয়ে নাও। বুড়ি হাত বাড়িয়ে নিল। এ পরিচর্যা ছাড়া কি বলবেন বলুন? রাস্তাঘাটে পোঁটলা বস্তা জড়িয়ে বসা ভিখারির চারদিকে কুকুরের মেলা দেখেননি? আমি অনেকবার দেখেছি। ওখানে জীবন হাত-পা ছড়িয়ে বসে। শ্বাস নেয়। ওখানেই স্বাভাবিক প্রাণের স্পন্দন।
মানুষ আধপেটা খেয়েও হাতে হাত রেখে পাশাপাশি বেঁচে থাকতে পারে, কিন্তু চারবেলা খেয়েও বিনা পরিচর্যায় বাঁচে না। শ্বাস নেওয়া মানে বেঁচে থাকা যদি বলেন সে আলাদা কথা অবশ্য। আসলে দেখেছি মানুষ মানুষকে কিছু না দিয়ে যায় না। শুধু ভালোবাসা না। উপেক্ষা, অপমান, বিশ্বাসঘাতকতা, ছলনা --- কিছু না কিছু সে দেয়ই। আমি এ সবই পেয়েছি। কিন্তু ফেলে দিইনি বলেই হয় তো এরা প্রত্যেকে আমাকে অল্প অল্প গড়ে উঠতে সাহায্য করেছে। আমি একটা জিনিস মানি, এই জীবনটা তো আমি এই প্রথমবার বাঁচছি। সুতরাং এরকম হয় না, হতে পারে না - এ কি করে বলি? আমার জীবনটা তো কোনো রিভিসন কোর্স না। তাই সব হাত পেতে নিই। সব কিছুর কাছেই ঋণী থাকি। শুধু যে মানুষটা আমার দোষগুণ মিলিয়ে আমায় ভালোবাসে তার কাছে একটু সহজ হয়ে বাঁচি। বাকি জায়গায় গম্ভীর হয়ে। শান্তি আদতে খুড়োর কল। দোষে-গুণে, ভালোয়-মন্দে, উদ্বিগ্নতা-অনুদ্বিগ্নতায় এ খরস্রোতে বয়ে চলে যেতেই হয়। যা আছে তাকে নিয়ে ভাবি না, যা নেই তাকে ভেবেও বানাই না --- এই তো কথা।
ইংরাজিতে দুটো শব্দ আছে --- শো আপ আর শো অফ। 'শো আপ' মানে হল নিজেকে দৃশ্যগোচর করা, আর 'শো অফ' মানে হল নিজের দম্ভকে দেখানো। আমি প্রথমটায় বিশ্বাসী। নিজেকে লুকিয়ে আড়াল করে বেঁচে লাভ কি? নিজের অনুভূতিকে লুকিয়ে অন্য মানুষ সেজে বেঁচে থাকব কেন? রুমি বলতেন, কেউ হাত তখনই ধরে যখন কেউ হাতটা বাড়িয়ে দেয়। আমার হাতটা হ্যাঁচকা টানে টেনে নিয়ে কেউ আমার হাতটা ধরল না কেন, এ অভিমান তো মেন সুইচ অফ্ করে লাইটের সুইচের উপর অভিমান করার সামিল। তবে কি ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ, তিরস্কার ইত্যাদি নেই? আছে। ওদেরও দরকার আছে বলেই আছে। জীবন কি আর যে সে মালি, জাত মালি। সে যখন বাগানে আসে তখন শুধু সার আর জল নিয়ে আসে না, কাঁচি-ছুরিও নিয়ে আসে, ডাল কিছু ছেঁটেকেটে ফেলার জন্য। সেও পরিচর্যারই অঙ্গ। নইলে অকারণ অভিমান বেড়ে গিয়ে শুঁয়োপোকার ঢিবি বানিয়ে দেয় সারা শরীরে। নিজেরও জ্বালা, অন্যেরও জ্বালা তাতে।