কতটুকু জমায় মানুষ অবশেষে? বাইরে যা জমে সে বাইরের জিনিস। নিজের ভিতরে যা জমে, সে কতটুকু? ক্ষোভ, অভিমান, দু:খ, শোক। আর কিছু অভিজ্ঞতা, যাকে সে বলে জীবনবোধ। আর কি জমায় মানুষ? যে সব জিনিসের দিকে তাকিয়ে সে গর্ব করে বলতে পারে, এ আমার!
মানুষ নদীর তীরের মাটির মত। রোজ ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছে। সে বিশ্বাস করে তার এই রোজকার ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাওয়া কোথাও হয় তো গিয়ে জমছে। আবার সে বিশ্বাসও হারিয়ে যায় অনেক মানুষের। তার মনে হয় সে শুধুই ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছে। রোজ অল্প অল্প করে ভাঙন ধরছে। চিড় ধরছে। একটা বড় স্রোতের ধাক্কায় হয় তো বা সে গোটাটাই হারিয়ে যাবে।
এই ভাঙন লাগা মাটির উপর এক চিলতে তার সাম্রাজ্য। খুব চায় আগলে রাখুক সে সবটুকু। সে এই নড়বড়ে মাটির উপর অক্ষয় দেবতার মন্দির বানায়। বলে আমার এই ভাঙনকে রক্ষা করো। আমি তোমায় তুষ্ট রাখব। তুমিও আমায় দেখো। কেউ কেউ নানা দর্শনের বেড়া দেয়। বলে এই আমার সত্যজ্ঞান, এই বেড়া ভেঙে কিছুই ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না আমাকে।
তবু সব ভেসে যায়। তত্ত্বের বেড়া ভেঙে যায়। দেবালয় ভেসে যায়। তার মনে হয় এ বিশ্ব সংসারের নেপথ্যে এমন এক শক্তি আছে যে তার প্রার্থনা, সাধনা, উপবাস, আত্মত্যাগ… কিচ্ছুর পরোয়া করে না। সে নিজের খেয়ালে চলে। চাইলেই সব তছনছ করে দেয়। আবার চাইলেই শরতের আকাশের মত নিরীহ সরল সাজে সেজে আসে। ছলনা! কি দু:সহ ছলনা। কখনো আবার তার মনে হয় আসলেই সব শূন্য। কোথাও তো কিছুই নেই। গোটা সৃষ্টি কেবলই ঘটনার পারম্পর্য মাত্র। অর্থ বলতে শুধু কার্যকারণ সূত্র, তার কোনো উদ্দেশ্য নেই। উদ্দেশ্য শূন্যতার ক্ষোভ চিত্তকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। সে বিশাল শূন্যতার উপর বড় একটা শূন্য এঁকে বলে, এই আমার তত্ত্ব তবে। সব অর্থহীন।
অবশেষে কি জমায় মানুষ তবে? এক রাশ শূন্যতা? অর্থহীনতা? বুদ্ধি, অস্তগামী সূর্যের দিকে তাকিয়ে কেঁদে ওঠে, বলে কিছুই বুঝলাম না। হৃদয় মৃত আশার কঙ্কালসার হাতের মুঠোর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, কিছুই ধরা দিল না তো!
মানুষ হারায় না। অন্তত যতদিন না পৃথিবী তাকে অবলুপ্ত ঘোষণা করছে সে হারাবে না। মানুষ হারায় না, একটা পরিচয় হারায়। অতি যত্নে গড়া এক মুঠো ধুলো হারায়।
মরমী চিত্ত এ শূন্যতার দিকে তাকায়। হাত থেকে সরে সরে যাওয়া সময়ের দিকে তাকায়, যেন বালির স্রোত। কোনো একটা বালিতে মহাকাশচারী সূর্যের আলো ঠিকরে তার চোখে লাগে। চোখে জল আনে। সে বলে, মহাকাশচারী এ আলোর নাম কি জানো, দরদ! বাইরের অসীম আকাশ যেমন নক্ষত্র ছাড়া অন্ধকার, মহাশূন্য শুধু, তেমনই চিত্তের এ মহাকাশ দরদের আলো ছাড়া মহা অন্ধকার। বাইরের অন্ধকারের থেকেও আরো বেশি অন্ধকার। চিত্ত, তুমি আত্মকেন্দ্রিকতা ভোলো।
একটা প্রজাপতি তখন হয় তো কোনো ফুলের উপর বসে, মকরন্দে আটকে পা, একটা তারা খসে পড়ছে আকাশ থেকে, কোথাও পাড় ভাঙার শব্দ……
তবু এ শূন্যতার ভয়াল, উদাসীন ছদ্মবেশে কে যেন এসে দাঁড়ায় ছায়ার মত, মরমী তাকে চেনে দয়াল, সোনার মানুষ বলে…. সে বলে ভয় নেই মাঝি….. নাও খোলো….. ভাসতে ভাসতেই ভয় কাটে…. নোঙর তোলো….. নিজেকে ভুলে নিজেকে পাও….