Skip to main content
চক্র

সাইকেলের চাকা। টোটোর চাকা। বাইকের চাকা। বাসের চাকা।
রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছি বন্ধুর আসার অপেক্ষায়। সামনে হুসহুস করে চাকার দল ছুটে চলে যাচ্ছে। তার উপরে মানুষ। ব্যস্ত মানুষ, চিন্তিত মানুষ, খোশমেজাজি মানুষ, দুঃখী মানুষ। রোগা মানুষ, মোটা মানুষ। গরীব মানুষ, ধনী মানুষ, মধ্যবিত্ত মানুষ।
সবাই চাকার উপর। কেউ যাচ্ছে। কেউ নিজেকে নিয়ে যাচ্ছে, কেউ কাউকে নিয়ে যাচ্ছে। চাকার পর চাকা ঘুরে চলেছে। চাকার পর চাকার সারি।
প্রাণীবিদরা বলেন, আমাদের দেহ জুড়েও এক মস্ত চাকা ঘুরে চলেছে। হৃৎপিণ্ড থেকে রক্ত বেরিয়ে বনবন করে সারা শরীর ঘুরে ফের ঢুকে পড়ছে হৃৎপিণ্ডে। কোষের মধ্যে কি এক সান্দ্র বস্তু আর সব কিছু নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোষ ভাঙছে গড়ছে এও নাকি ভীষণ এক চক্র - কোষচক্র।
ওদিকে পরিবেশবিদরা বলছেন, সারা পরিবেশ জুড়েও চলছে এক বিশাল চক্র। নাইট্রোজেন, অক্সিজেন, কার্বন ডাই অক্সাইড ইত্যাদিরাও আবদ্ধ হচ্ছে, আবার মুক্ত হচ্ছে, এমনধারা ছোঁয়াছুঁয়ি খেলছে।
ওদিকে মহাকাশবিদরা বলেন সব গ্রহ-নক্ষত্র নাকি ঘুরে চলেছে অনন্তকাল ধরে। পরমাণুবিদরা বলেন, সব অণু-পরমাণুও নাকি ঘুরে চলেছে সাঁইসাঁই করে।
আবার ওদিকে ঋষিমুনিরা বলেন আমরাও নাকি জন্ম-মৃত্যু চাকায় ঘুরে চলেছি যুগযুগান্ত ধরে। প্রাণীবিদ হেকেল মশায় বলেন, প্রতিটা জীব যখন মাতৃগর্ভে আসে, সে পুরো অভিব্যক্তির পথটা নাকি ঝালিয়ে নেয় ওইটুকু সময়ের মধ্যেই। মানে আর কি এই যেমন আমরা। আমরা তো মানুষ (নীতিবাগীশরা কি বলেন তা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই, মানে প্রাণীবিদদের কাছে তো আমরা মানুষই, সে চরিত্র আমার যাই হোক না কেন) তা সেই মানুষ হওয়ার আগে আমরা যা যা ছিলুম (মানে ওই বিজ্ঞানী দাদাভাইবোনেরা যা যা খুঁড়ে খুঁড়ে বার করেছেন আর কি), আমরা নাকি মায়ের গর্ভে ওই পুরোটা একবার রিভিশান দিয়ে তবে ধরাধামে ল্যান্ড করি। অর্থাৎ কিনা সেই চাকার গল্প।
এই সব ভাবতে ভাবতে মাথাটা আমার ভোঁ ধরে গেল। যেদিকে তাকাই চাদ্দিকেই চাকার খেলা, বাইরে ভিতরে চরকির মত ঘুরে বেড়াচ্ছে চাকা।
তবে আমার এই অস্তিত্বটাও নিশ্চই কোনো এক বিশাল চাকার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র, তস্য ক্ষুদ্র, মানে এমনই ক্ষুদ্র যা ধারণাও করা যায় না, সেইরকম একটা ক্ষুদ্র আবর্তনের অংশ! এই যে আমি হঠাৎ করে এই মহাপ্রাণসাগরে ভেসে উঠেছি, এই যে আমাদের সবার সাথে দেখা হওয়া, পরিচয় হওয়া একি সবটাই আকস্মিক? সে মহাকালের আবর্তন আমায় চেনে? না চেনে না। সাগর কি তার সব ঢেউকে মনে রাখে? রাখে না তো। তাতে আমার কোনো ক্ষোভ নেই। কিন্তু যে অনন্ত চেতনার সাগরে এক লহমার আভাসে আমি ফুটে উঠছি, সেই ভাগ্যটুকু কি নিতান্তই একটা চান্স? না না না। হতে পারে না। তাহলে এমন করে এত সুখ, এত দুঃখ, এত চেষ্টাকে নিয়ে এমন নিবিড় আনন্দে ভরে উঠত না জীবন। সবকিছুই অর্থহীন হয়ে পড়ত তবে। আকাশের সব গ্রহনক্ষত্র'র এমন সামঞ্জস্য থাকত না, মহাকালের সব কিছুই হত অনর্থক, তার বিশ্বব্যাপী লীলার সাথে আমার চেতনার যোগসূত্র খুঁজে না পেলে।

তাই বিশ্বাস করি সে এমনি এমনি ডাকেনি আমায় তার সভায়। একটা সুর গাইতে ডেকেছে। একি কম সৌভাগ্য! হোক না সে নিতান্ত ছোট একটা সাদামাটা সুর। সেই গেয়ে বেড়াই নিজের সমস্ত শক্তিটুকুকে একত্র করে।
শুধু এইটুকু প্রার্থনা, সে সুর যেন চড়ায় না ধরি, আর সব সুরকে ছাপিয়ে এই কলতানকে বিঘ্নিত করার চেষ্টায়, ক্ষণিকের আত্মমোহের অহংকারে। সে কাজটুকু শেষ হলে যেন বিদায় নিই বিনা অভিযোগে, বিনা ক্ষোভে। সাশ্রুনয়নে তাঁর দ্বারে এসে, তাঁর বাঁশি তাঁকে ফিরিয়ে দিয়ে, নম্রচিত্তে যেন বলে যেতে পারি - আমি ধন্য, আমি কৃতজ্ঞ এই মহাসভায় ক্ষণিকের জন্য আসার আমন্ত্রণ পেয়ে। যা কিছু ভুলত্রুটি ক্ষমা কোরো।


(ছবিঃ সুমন)