আদৌ কোনটা সমস্যা আর কোনটা সমস্যা না, সেটা বোঝাই একটা জটিল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনটা তৈরি করা হয়েছে আর কোনটা নিজে থেকেই একটা সমস্যার রূপ নিয়েছে সেটা বড্ড গোলমেলে ব্যাপার। যেমন রোহিঙ্গা সমস্যাটা কিছুটা তৈরি করা আর বাকিটা ঐতিহাসিক জটিলতা। জল ঘোলা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মহল যতটা উদ্বিগ্ন হওয়া দরকার তা হয়ে উঠছে না। এ ওকে, সে তাকে দোষারোপ, চাপসৃষ্টি ইত্যাদিতেই সীমাবদ্ধ থেকে যাচ্ছে। এমনকি যথেষ্ট পরিমাণ ত্রাণের আয়োজনও হয়ে উঠছে না। ওদিকে এর সাথে যোগ দিয়েছে জঙ্গি সংগঠনের হুমকি। সারা পৃথিবীতে একটা বড় মহলে মুসলিম বিদ্বেষপরায়ণতার বাতাবরণ চলছে। যার মূল কারণ অবশ্যই মুসলমান ধর্ম আর সন্ত্রাসবাদকে এক করে দেখা। যে অভিযোগ রোহিঙ্গাদের উপরেও ন্যাস্ত করা হচ্ছে। কিন্তু মোট কথা একটা জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ চূড়ান্ত মানবিক বিপন্নতার মুখোমুখি যার জবাবদিহি নোবেলজয়ীকে ইতিহাসের কাছে করতে হবে। কারণ এত মানুষকে বিপন্ন করে, বঞ্চিত করে উন্নতির পথে যাওয়া যায় না, ইতিহাস সাক্ষী। তাদের বড় যুক্তি, তাদের এই নতুন স্বাধীনতায়, সদ্যজাত অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় বিষম বাধা এই রোহিঙ্গারা। বৌদ্ধরা নয়। তবে এ বৌদ্ধ সেই অহিংস বৌদ্ধ নয়।
আমাদের দেশে তৈরি হচ্ছে একটা অস্পষ্টতা। সমস্যাটা ঠিক কোথায় আমরা যেন বুঝেও বুঝতে চাইছি না। আমাদের অবস্থা অনেকটা সেই প্রভু আর তার সাধের পোষা সারমেয়টার মত হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রভু বিকালবেলা মাঠে গেলেন, সাথে সারমেয়টাও গেল। প্রভু একটা বল পুব দিকে ছুঁড়লেন, সারমেয়টা দৌড়ে গিয়ে সে বল নিয়ে এলো। প্রভু একে একে পশ্চিমে, দক্ষিণে, উত্তরে ছুঁড়ে গেলেন আর সারমেয় তার ল্যাজ নাড়তে নাড়তে সেদিক থেকে বল এনে দিতে লাগল। এমনকি মাঠের যে সমস্ত স্বাধীনচেতা সারমেয়ের দল ছিল তারাও এই বল আনা নেওয়া দেখতে দেখতে মূল সমস্যাগুলোর কথা ভুলে, বলের সমালোচনা, ছোঁড়ার কৌশলের সমালোচনা, সারমেয়ের প্রভুভক্তির সমালোচনাতে এমন মেতে গেল যে বাকি কথা কেই বা শোনে, কেই বা বোঝে আর কেই বা বলে।
আমাদের হঠাৎ করে বোঝানো হচ্ছে - তোমরা হিন্দু। তোমাদের একটা জাত্যাভিমান আছে। মানে থাকা দরকার। তোমাদের বিবেকানন্দ বলে একজন ছিলেন, যিনি না থাকলে আজ হিন্দু বলে যে অস্তিত্ব আছে তা ধুলিস্যাৎ হয়ে যেত। তোমাদের মনে রাখতে হবে যে তুমি যখন নিজেকে হিন্দু বলে ভাবতে শুরু করবে অবশ্যই তোমার কিছু প্রতিদ্বন্দী থাকবে যারা হিন্দু নয়। ইত্যাদি ইত্যাদি। এগুলো তৈরি করা সমস্যা। ভাবগত সমস্যা। এখন মুশকিল হল ভাবগত কৃত্রিম সমস্যার কোনো সীমারেখা হয় না। 'রাজার অসুখ' যে কারণে কোনো বৈদ্যের হাতে সারে না। সত্যকারের সমস্যার একটা সমাধান আছে তার সীমারেখাও আছে। তার বিধান বেরোবার সাথে সাথে তা অন্তর্হিত হয় শুধু না তা সমাজকে একটা নতুন পথে আর খাতে পরিচালিত করার ক্ষমতা রাখে। সতীদাহ প্রথা রদ হতে শুধু বিধবারাই বেঁচেছেন তা নয়, মেয়েদেরও যে একটা নিজস্ব অধিকার আছে বেঁচে থাকার, সেটাও তারা অনুভব করেছে। তারা জেনেছে, তাদের এ দুঃখটা তাদের একার ব্যক্তিগত দুঃখ নয়। এতে বিশ্ববাসীর প্রাণ কেঁদেছে। তার একার কান্না, একার অসহায়তা দেশের, বিশ্বের মানবিক আত্মাকে নাড়া দিয়েছে। এও নবজাগরণের একটা বড় ধাপ হয়ে দেখা দিয়েছে সেদিন। কোনো সত্যকারের সমস্যার সমাধান বের হলে, তাই বলছিলাম, সে একটা নতুন আলো নিয়েই আসে।
আমাদের অনেক সমস্যা আছে। তার পরিমার্জনের পথ না দেখিয়ে বর্তমানে তা আবরণের আড়ালে পড়ছে। বিশ্বের প্রথম দেশগুলোর সাথে আমরা হঠাৎ করে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছি। কিন্তু সে প্রস্তুতি কোথায়? আমাদের হঠাৎ যেন সেই 'অসময়ে ডাক পড়েছে, কেন যে তা কেই বা জানে' মতন দশা। অধুনা ভারতীয় অর্থনৈতিক সংস্কারের সাথে আমার একটা ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতা মনে পড়ছে। সংসারে যে কয়টা বস্তুর উপর আমার আকর্ষণ আছে, তার মধ্যে বইয়ের পরেই আসে হাতঘড়ি। তা দামী হতে হবে এমন কোনো কথা নেই, কিন্তু হাতে না থাকলে অস্বস্তি অনুভব করি (সাথে বই না থাকলেও করি। তাই পড়ি না পড়ি একটা বই সাথে থাকলে নিজেকে সনাথ লাগে)। তো আমার এক ভাই তথা বন্ধু এই প্রেমবশতঃ আমাকে একটা বেশ দামি ঘড়ি উপহার দিল। মুশকিলটা হল তার ডায়ালটা এতটাই বড় যে সে আমার থেকে বেশি দ্রষ্টব্য হয়ে উঠল। আমার চলতে ফিরতে মনে হতে লাগল আমার সমস্ত সত্তাজুড়ে একটা বিশাল ঘড়ি। কারণ সেটা আমার হাতের স্বাস্থ্যের সাথে বেমানান।
আজ আমাদের এই ডিজিটালায়ণ থেকে বুলেট ট্রেনায়ণ সবই কেমন রোগা হাতে প্রবল ঘড়ি সদৃশ্য ঠেকছে আমার কাছে। এত ভার নিতে পারবে তো? মোড়কে হয়ত আমরা বিশ্বের প্রথম দেশের মতন দেখতে হলাম, কিন্তু কেউ যদি প্যাকেট খুলে বসে? তাও নয় প্যাকেটের বাইরের স্তরে দামি দামি বস্তুতে সাজিয়ে রাখলাম, তাতেও যদি কারো মন না ভরে? সে যদি আরো গভীরে হাত দিতে চায়? আরো অনুসন্ধিৎসু হয়ে ওঠে। দেশের লোকদের না হয় বলব “ছুঃ... ওদিকে... ওই যে ধর্ম বাঁচাও... ধর্মে এসো... শোনো কি বলেছেন বিবেকানন্দ...”। কিন্তু সব লোক তো শুনবে না। কিছু লোক তো লঙ্কেশেদের স্মরণসভায় যাবেই তাদের কোনো রাজনৈতিক স্বার্থ বা উদ্দেশ্য না থাকলেও। আর এ জাতটা তো চুপ করে থাকার নয়। এরা ধর্ম নির্বিশেষে রাস্তায় হেঁটেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে চীৎকার করে গলা ফাটিয়েছে। ইদানীং কলকাতায় যে একটি বিশেষ ধর্মের জন সমাবেশ দেখা গেল রোহিঙ্গাদের অত্যাচারের জন্য তাদের কিন্তু বিগত সব এত নৃশংস জঙ্গি হামলায় জড়ো হতে দেখিনি আমি এমন প্রবলভাবে।
ভারতীয় হিন্দুদের একটা অংশ গোঁড়া হলেও সামগ্রিকভাবে তা নয়। তাই যে কোনো জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে প্রতিবাদের সাক্ষী ভারতের পথ মাঠ ঘাট হয়েছে। "বিশ্বের সকল হিন্দুভাইয়েরা শান্তিতে থাক"... এরকম একটা প্রার্থনা আমাদের কানে লাগে, অন্য অনেক ধর্মের কানে না বাজলেও।
অনেকে ভাবেন এটা আমাদের দুর্বলতা, নিজের ধর্মের প্রতি অনানুগত্য, অনাস্থা, ঔদাসীন্য ইত্যাদি। কিন্তু আমার মনে হয়, হিন্দুধর্মই হিন্দুর ধর্মকে ছড়িয়ে এগিয়ে যেতে বেশি উৎসাহিত করেছে। কারণ হিন্দু ধর্মকে আঁকড়ে বাঁচতে চায়নি, হিন্দু ধর্মকে নিত্যনতুন আবিষ্কার করতে চেয়েছে। তাই হিন্দুধর্মে অসংখ্য অবতারের বিশ্বাস আছে। তারা আবিষ্কার করবেন, মেনে নিতে বলবেন না। সে ধর্মে ঈশ্বরও শেষ কথা নয়, সে ধর্মে শেষ কথা 'মঙ্গল'। একের মঙ্গল না, 'বহুজনহিতায় বহুজনসুখায়'।
এইখান থেকেই আমি মোড় ফেরাতে চাইছি আমার আলোচনার। বিজ্ঞান, অর্থনীতি, সমাজনীতিকে আজ এই ধর্মের উপর প্রতিষ্ঠা না করলে বিপদ – 'বহুজনহিতায় বহুজনসুখায়'। সত্যি আমাদের আজ প্রচুর সমস্যা। বেঁচে থাকার প্রাথমিক শর্তগুলোই সর্বত্র পোঁছে উঠতে পারিনি এখনও। তাদের অসীম সহ্যক্ষমতা, অভিযোগহীনতা, আত্ম-অধিকার সম্বন্ধে অজ্ঞতার উপর যদি এই মোড়ক সংস্কার দাঁড় করাতে চাই তবে যে একদিন সমূলে ধ্বসে পড়বে সব। সে ভার কে বইবে? সেদিন হয়ত মসনদে আরেক রাজা, কিন্তু সে ক্ষতিপূরণের ভার তো বইতে হবে লক্ষকোটি শান্তিপ্রিয় এ সাধারণ মানুষের প্রবাহকে। আমাদের বর্তমানে মহাপুরুষদের ভুললে ক্ষতি নেই। তাদের কথাগুলো ভুললেও ক্ষতি নেই। কিন্তু যে উদ্দেশ্যে তারা জীবনধারণ করেছিলেন সেই জীবনীটা ভুললে বিপদ। কোনো মানুষের বিক্ষিপ্ত বাণী ভুল ধারণা তৈরি করতেই পারে, কিন্তু পুরো জীবনটা জানা থাকলে জীবনের মূল সুরটা বোঝা যায়। আর তখনই কোন কথাটা মুখ্য আর কোন কথাটা গৌণ সেটা বোঝা সহজ হয়ে পড়ে।
সেগুলোকে উপজীব্য করেই প্রধান সমস্যাগুলোর দিকে চোখ ফেরানো যাক। শিক্ষার মানের একটা যথার্থ সাম্যতা আসুক সারাদেশে, স্বাস্থ্যের ন্যূনতম সুবিধাগুলোর আওতায় আসুক দরিদ্রতম মানুষটা, বেকারত্বর সমাধানের কথা আরো সিরিয়াসলি ভাবা হোক, পানীয় জল, পায়খানা বাথরুম, আবাস প্রকল্প আরো ঠিকভাবে মনিটরিং করা হোক। দেশের বড় বড় অর্থনীতিবিদদের গায়ে রাজনৈতিক রঙ না বুলিয়ে, অতীতের গৌরবের মোহ ছেড়ে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান আরো কিসে মসৃণ করা যায় সেগুলো ভাবা হোক। স্বাস্থ্য মজবুত হলে যেমন অনাক্রম্যতাও বেড়ে যায়, তেমনি তখনই আমরা ওই সব মোড়ে মোড়ে, ফটোতে ফটোতে অস্তিত্বসংকটে ভোগা মহাপুরুষদের সাচ্চা উত্তরসূরী হব। ব্যাসদেবের উত্তরসূরী নিশ্চই রামরহিম বা আশারাম বেরোবে না সেদিন।