Skip to main content

সাম্যবাদ কি পুঁজিবাদ না, অবশেষে প্রয়োজনবাদ। আদর্শ, নীতি ইত্যাদির যুগ কোথাও একটা শেষের দিকে। এখন দেখতে হয় আদর্শ বা নীতি কতটা উচ্চ বা মহান না, কতটা ফলপ্রসূ। কারণ, চাই সুখ। আমার প্রয়োজন সুখ। শীতকালে লেপ, রুম হিটার। গরমকালে এসি, কুলার। সকালের চা থেকে রাতের ঘুম – সব আমার প্রয়োজন, আমার সুখ। মাঝে যা আসে সবের মূল সূত্র – সুখের আস্বাদ অথবা ভবিষ্যতের সুখের প্রতিশ্রুতি। আমার স্বপ্ন, আমার ইনভেস্টমেন্ট। আমার রাজনৈতিক মতাদর্শ আমার সুরক্ষা। আমার স্বপ্নের সুরক্ষা। আমার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুরক্ষা।

এ কিছু নতুন তত্ত্ব না। বহু আগে অ্যারিস্টটল, এপিকুরিয়াস হয়ে বেন্থামের লেখনীতে তা প্রায় পূর্ণ মাত্রা পেল। পরে আরো নাম করা দার্শনিক, লেখক, গায়ক ইত্যাদিরা সেই মতের ধারক বাহক হলেন।
সুখের প্রতি আকর্ষণ, আর দুঃখের প্রতি বিকর্ষণ সমস্ত জীবের প্রাথমিক চালিকাশক্তি। এখন এই সুখের প্রকারভেদ অবশ্যই হয়। শারীরিক সুখ, মানসিক সুখ। মানসিক সুখ আবেগজনিত ও বুদ্ধিজনিত ভাবা যেতে পারে। শারীরিক সুখের – আহার নিদ্রা মৈথুনের আস্বাদে আমরা পশুর সাথে এক গোত্রভুক্ত, অভিব্যক্তির পথের প্রমাণস্বরুপ ।
এর পরের ধাপ, বৌদ্ধিক ও আবেগজনিত। পেশার সুখ যদি এই দুটোকে নিয়ে হয় তবে কেয়াবাৎ! আমার বুদ্ধি ও আবেগ একই সাথে সার্থকতা খুঁজে পাচ্ছে – তা উত্তম সাহিত্য, উত্তম সিনেমা, উত্তম শিল্পকলা।
এর পরের ধাপ আধ্যাত্মিক সুখ। খুব দুরূহ ভাষায় বোঝানো। যে বোঝে সে বোঝে। বাকিরা লড়ে মরে, তর্কের প্রাচীরে মাথা কুটে মরে। রামকৃষ্ণদেবের কথা অনুযায়ী – বিষয়ানন্দ, ভজনানন্দ ও ব্রহ্মানন্দ।
ভজনানন্দ কি? সাধনার আনন্দ। সাধনা কি? আত্মজয়ের চেষ্টা। ক্ষুদ্র সুখের ত্যাগ বড় সুখের চরণে। এতে যদি সুখের ভাগটা বাদ দেওয়া যায় তবে তা আসুরীক চেষ্টা, গীতার মতে।
ব্রহ্মানন্দ এর পরের। ঠাকুরের কথা অনুযায়ী, পেনসান ভোগের আনন্দের মত। আরেক জায়গায় বলছেন, দাঁড় বেয়ে খালবিল পার হয়ে বড় নদীতে পড়ে, পাল তুলে, হুঁকো সেজে পায়ের উপর পা তুলে নৌকার পাটাতনে শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখা।
সে উচ্চকথা থাক, যার হয় হোক। কথা হচ্ছে বড় বড় উচ্চাদর্শ যে আজ জোট বেঁধে দেশ বাঁচাবার আছিলায় দেশোদ্ধারের কাজে নামতে চাইছেন, তাতে দোষের কিছু দেখি নে। এ যুগই হল প্রয়োজনের। হতে পারে সেই প্রয়োজনের চূড়ান্ত নিম্নধাপ শোষণ-উৎপীড়নে এসে দাঁড়িয়ে যায়, তবু তার থেকে অব্যাহতির কোনো রাস্তা বৃহতের দরবারে নেই। আসে ইউনিয়ান, বিভিন্ন প্রকার সংগঠন – আরেক প্রয়োজনবাদ। বড় শাসকের হাত থেকে রেহাই পেয়ে ক্ষুদ্র শাসকের হাতে। খামচা খামচি, খিমচা খিমচি। এর কি ভয়ংকর পরিণাম হতে পারে পশ্চিমবঙ্গবাসীর জানতে বুঝতে আর বেগ পেতে হয় না।
কথা হল এই প্রয়োজনের তবে কোনো নীতি, বিবেক নেই? আছে, আবার নেইও। আপেক্ষিক স্তরে আছে। চূড়ান্ত স্তরে নেই। শরীরে ঘা হলে পোকা হয়। শরীরের স্বার্থে ঘা সারানো প্রয়োজন, পোকার স্বার্থে ঘা'টাকে আরো দগদগে করে রাখা। কি করবেন? বুদ্ধিমান বুঝিয়া লও।
এই নিষ্ঠুর খেলাটাই কি শেষ কথা তবে? না। আসে প্রেমবাদ। তার নিরানব্বই ভাগ প্রয়োজনের রাহুতে ঢাকা হলেও, একাংশ সব যুগেই বাইরে থাকে। কিছু মানুষ নিজের প্রয়োজন ছাপিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ায়, ভালোবাসে। নিজের উদরান্ন তার পাতে দেয়। এও আছে। এরাই বাঁচেন, এরাই পথ কাটেন। এরাই আলো আনার তীর্থযাত্রায় প্রাণ দেন।
আর আছে উন্মাদবাদ। এরা ভালো মন্দ কিছু বোঝেন না, বোঝেন এক'টাই শব্দ – প্রতিশোধ, হিংসা, উত্তেজনা। এরা ধর্মের, রাজনীতির ছদ্মবেশে থাকে। চূড়ান্ত পবিত্র সমাজের কথা বলে, চূড়ান্ত উদারতার কথা বলে। এরা বলে মানুষ মানি না, ঈশ্বর মানি। এরা বলে দেশ মানি না, বিশ্ব মানি। মানে জল মানি না, সাগর মানি।
এর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে চলা বাপু চাট্টিখানি কথা না। শুধু দেখে যাও। শুনে যাও। নিজের উপলব্ধি আর বিশ্বাসের সাথে সৎ থেকে যাও। যতটা ভালোবাসা যায়, যতটা ক্ষমা করা যায়, যতটা নির্লোভ থাকা যায় তাতে নিজেরই মঙ্গল। উপদেশের মত শোনাল? তা না, শান্তিদেশের কথা বললুম।