নেক ইনশান। মানে কি বুঝি? না, সাদামাটা ভালো মানুষ। এখন সেই 'নেক' শব্দ থেকে বাংলায় কি শব্দ জন্মালো? না, ন্যাকা, বা নেকা। কোনো মানে হয়? বলি ভালো মানুষ আর ন্যাকা মানুষ এক হল?
তো শব্দের উৎস যাই হোক না কেন, এখনের মানে হল, যে জেনেও না জানার ভান করে। তবে কথা হচ্ছে, 'ন্যাকা সাজা' কথাটার মানে কি দাঁড়াবে? মানে আরকি ওই এক, জেনেও না জানার ভান করা। খুব পার্থক্য কিছু হচ্ছে না।
তবে ভালো মানুষ মানে কি? গুরুচরণ দাস মহাশয় একটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ বই লিখেছেন এই নিয়ে, দ্য ডিফিকাল্টি অব বিং গুড। কথাটা তো আমাদের বার্ণাড শ মশায়ও বলতেন, ইট ইজ ডেঞ্জারাস টু বি টু গুড। খুব ভালো হওয়া খুব ভয়ংকর। ভালো হওয়া মোটেই সোজা কাজ নয়। ওর কোনো বাঁধাধরা সংজ্ঞাও হয় না। অন্যের বা নিজের ক্ষতি না করলেই তা ভালো। এই মোটামুটি বলা যায়।।
তবে ন্যাকা হওয়ার সুবিধাটা কি? সুবিধা হল যে, আদতে আমি ভালো নই, কিন্তু ভালো হওয়ার ভান করতে তো অসুবিধা নেই। নীতিজ্ঞানের মধ্যে ক্যামোফ্লাজ করে থাকা আরকি। বাইরে থেকে মনে হবে আমি কিচ্ছুটি জানি না, মানে ভাজা মাছ উল্টে খাওয়া কি, আমি মাছ ভাজা হচ্ছে তাইইইই জানি না! এতটাই ন্যাকাষষ্ঠী, ন্যাকাবোকা আমি। সাত চড়ে রা কাটি না! ধরা পড়লেই দোষ স্বীকার করে নিই। বলি, আহা, আমি কি আর জেনেবুঝে করেচি! অজান্তে হয়েছে গো। ক্ষমা চাই। আবার একই কাজ করি। আবার দোষ স্বীকার করে নিই। আবার ক্ষমা চাই। কারণ আমি ন্যাকা। ভীষণ ন্যাকা। আমি আসলে যে কিছুই জানি না, বুঝি না গো। রামকৃষ্ণ, মহাপ্রভু, খ্রীষ্ট হতে হতে একটুর জন্যে আটকে গেছি আর কি!
এটা আসলে একটা ডিফেন্স মেকানিজম। প্রাণীকূলে দেখা যায় না? যায় তো! সে সাপের বিষ নেই, সেই সাপ বিষধর সাপের মত আচরণ করছে। গাছের ডগা এমন ফণা তুলে আছে, গরু দেখে ভাবছে আসলে সেটা সাপ। গিরগিটি কেমন রঙ বদলে নিচ্ছে। তো এমন কালারেশান, মিমিক্রির উদাহরণ প্রচুর আছে প্রাণী জগতে। বেশির ভাগই দুর্বলের আত্মরক্ষার জন্য। তো মনুষ্য সমাজেও তাই। দুর্বল যে, সে ভালো তো হতে পারবে না। অত আত্মবিশ্বাস তো নেই। আসলে সে তো জানেই না যে ভালো হওয়া মানে ঠিক সে যেরকম ভালো হওয়া বোঝে সেরকম তো আদতে নয়। কিন্তু সে আর কবে প্র্যাক্টিস করে দেখল।
দুরকমের শিক্ষা হয়। এক কগনিটিভ লার্নিং। তাত্ত্বিক জ্ঞান আরকি। বইটই পড়ে যা হয়। আর এক শিক্ষা হল আচরণগত শিক্ষা। সে তো অনুশীলন না করলে হবে না বাবা! সাইকেল চালানো, সাঁতার কাটার মত নিজের আবেগ, প্রবৃত্তিকে বশে আনার শিক্ষা। তো সে তো মহা ঝকমারির কাজ! কে করে! তার চাইতে ভালো হতে না পারি, ভালো সাজতে অসুবিধা কোথায়?
অসুবিধা তো আছে। সাজতে গিয়ে এতটা সেজে ফেলে যে বাস্তবে অত ভালো মানুষ হয় না! এরও উদাহরণ আছে। এমন কিছু ডাই দেখেছি লোকে মাথায় করে, যে তার যৌবনে চুলের অমন ধারা কালো রঙ কোনোদিন ছিল না! প্রকৃতি যা দিতে পারেনি, কোম্পানি তা-ই দিয়ে দিচ্ছে! চোখে ঠেকছে। বড়ই বেমানান। তেমনই অত অসংগত ভালোত্বও বেমানান।
তো ন্যাকা মানুষের ভালোত্ব সহ্য করা তাই এমনই দুষ্কর এক সমস্যা। বেশ বুঝতে পারছি হদ্দ ন্যাকামি করছে, কিন্তু প্রোটোকল ভেঙে কিছু বলাও যাচ্ছে না। অগত্যা উপায়? এড়িয়ে যাওয়া। তার সঙ্গে যতটা দূরত্ব রেখে চলা যায় ততটাই মঙ্গল।
তবে এ হল গিয়ে হদ্দ ন্যাকার কথা। বাকি অল্পস্বল্প ন্যাকামি আমাদের তো সব্বাইকেই করতে হয়। কিন্তু সে ন্যাকামিকে স্বভাবে না গড়ে তুললেই হল। নইলে 'ন্যাকা আমি' আর 'আসল আমি' ঘেঁটে এমন এক টক্সিক আমি তৈরি হবে ধীরে ধীরে যে নিজেকেই অসহ্য লাগতে শুরু করবে। কিন্তু প্রয়োজন বিশেষে ন্যাকা হতে দোষ নেই। সে ছোটোবেলার চানাচুরের শিশি খালি করে ন্যাকা সাজা হোক, কি বড়বেলায় ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে হোক। ন্যাকা ক্ষেত্র বিশেষে সাজতেই হয়। শুধু স্বভাবে না গড়ালেই হল।