Skip to main content

"ঠাকুর মোরে ক্ষীর দিল সর্বলোকে শুনি।

দিনে লোক ভীড় হবে মোর প্রতিষ্ঠা জানি।।

এই ভাবি রাত্রিশেষে চলিলা শ্রীপুরী।

সেই স্থানে গোপীনাথে দণ্ডবৎ করি।।"

 

প্রচলিত এই গল্প শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু-র গুরু ঈশ্বরপুরী-র গুরুদেব মাধবপুরীকে নিয়ে। গল্পে আছে যে ক্ষীরচোরা গোপীনাথ মাধবপুরী-র জন্য ক্ষীর আলাদা করে রেখেছিলেন এবং পুজারীকে স্বপ্নে সে ক্ষীর মাধবপুরী-কে দিয়ে আসার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

শ্রীভগবানের এ হেন নির্দেশ পেয়ে যখন পুজারী ক্ষীর মাধবপুরীর কাছে নিয়ে যান, তখন মাধবপুরীর উক্ত অনুভব হয়। এবং তিনি সেই রাত্রেই সে স্থান ত্যাগ করেন। পাছে লোকে জানাজানি হয়ে যায়। ভিড় হয়।

মাধবপুরী আত্মমগ্ন। স্বার্থমগ্ন না, আত্মমগ্ন। অনুভবে মগ্ন। হিসাবে মগ্ন না।

গভীরে বাজছে সুর। বাইরে সে সুর আসছে না। আটকে রাখছি। মোহে। ভয়ে। দুশ্চিন্তায়। বারবার বলছি, ভালো নেই, ভালো নেই। সব খারাপ। সব মিথ্যা। সব দূষিত।

গভীরে কান পাতছি না। গভীরে পাতাল। গভীরে আঁধার। গভীরে হারাবার ভয়।

ঘটনা সামান্য। কিন্তু গভীরতায় অপরিমেয়। সবাই বলছে, তুষ্ট হও। শান্ত হও। এত প্রশ্নে, এত ক্ষোভে, এত দুশ্চিন্তায় জর্জরিত কোরো না নিজেকে। নিজেকে লোভের হাত থেকে বাঁচাও।

কিছুতেই পেরে উঠছি না। কত যেন দায়িত্ব আমার! অথচ এতটুকু স্বার্থহানিতে জগত অন্ধকার। সব ছল ছল ছল। নিজের বাইরে কাউকে চিনি না। জগত উদ্ধার, সেবা, দরদ…সব ছল। মুখোশ। এতটুকু স্বার্থে আঘাত লাগুক, আমি কে বুঝিয়ে দেব। বুঝিয়ে দেব আমার আসল চেহারা কি! এতটুকু নিজের অস্তিত্ব-সংকট দেখা দিক, আমার সব মহত্ত্ব শূন্য। আমার সবটুকু শূন্য। তখন আপনি বাঁচলে বাপের নাম!

এই ছলের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাই কি করে? নিজেকে এই যে রাতদিন কেউকেটা সাজিয়ে রাখার ব্রত নিয়েছি, এর থেকে আমায় বাঁচায় কে?

মাধবপুরীর প্রাণে সে উত্তর আছে। সে উত্তর - আনন্দ। অভয়। নিজেকে শূন্য করে, নিজেকে আড়ালে রেখে নিজের আরাধ্যকে উজাড় করে সবটুকু দেওয়া।

আরাধ্য কে? যে আমার আরাধনার। যে আমার প্রাণের আনন্দস্বরূপ। শান্তিস্বরূপ। মুক্তিস্বরূপ। তাকে বাইরে ভিতরে দু'দিকে না পেলে সার্থকতা নেই। মাধবপুরী যেখানে যায় লোকে ভিড় করে আসে।

 

"প্রতিষ্ঠার স্বভাব এই জগতে বিদিত।

যে না বাঞ্ছে তার হয় বিধাতা নির্মিত।।

প্রতিষ্ঠার ভয়ে পুরী গেল পলাইয়া।

কৃষ্ণভক্ত সঙ্গে প্রতিষ্ঠা চলে গড়াইয়া।।"

 

মাধব চান না লোকে তাঁকে জানুক। কিন্তু লোকে মাধবের মধ্যে যে আলো দেখেছে সে কি? এমন স্বার্থগন্ধহীন, আত্মহীন আত্মা, আনন্দময় পুরুষ…. এ কে? কে ইনি?

এক পরিচয় বুদ্ধিগত। আরেক পরিচয় হৃদয়গত। মাধবকে চিনেছে মানুষ হৃদয় দিয়ে। এত ছোটাছুটি, এত হিসাব-নিকাশ তবু শান্তি কই? এত উদ্বেগ, এত মারামারি হানাহানি, এ সবের থেকে রেহাই কে দেবে?

একজন তুষ্ট মানুষ। একজন সম্পৃক্ত মানুষ। যে কপট নয়।

মাধবপুরীর জীবনীর শুধু এইটুকুই আজকের দিনে আমাদের কাছে এক বিরাট আলো। আজ এই গুরুর ছদ্মবেশে নানা গডম্যানদের যুগে, যেখানে অলৌকিক ক্ষমতা, বিশেষ ক্ষমতা, রাজনৈতিক ক্ষমতা, সর্বোপরি তাদের বিশাল প্রভাবের বিজ্ঞাপন, ধনসম্পদের ইস্তাহার সেখানে এমন নিরহংকার, এমন অলোকসামান্য মানুষের স্মৃতি স্বস্তির।

মানুষের ভাবের জগত আর বিচারের জগত। এই দুইয়ের মধ্যে ভাব দূষিত হলে বিচারও দূষিত হয়, চিন্তাও দূষিত হয়। আবার বিচার সঙ্কীর্ণ হলে ভাবও সঙ্কীর্ণ হয়। তবে দেখা যায় প্রথমটার প্রভাবই সব চাইতে বেশি। যে মানুষ হাওড়া স্টেশন অবধি ক্ষুন্ন, নানা চিন্তায় জর্জরিত, সে-ই পরেরদিন পুরী-র সমুদ্রের সামনে বসে ভাবছে, সে পারবে, সে লড়াইয়ে জিতবে। তার বিচার বদলে যাচ্ছে। কারণ তার ভাব বদলে যাচ্ছে। এই বৃহতের সামনে এসে দাঁড়িয়ে।

মাধবপুরী ভাবের জগতে এমনই এক সাগর। খুব বড় বড় বই পড়ার দরকার নেই। এই এতটুকু ঘটনাই আমাদের আত্মকেন্দ্রিকতার ডিটক্সিফিকেশানের জন্য যথেষ্ট। অন্তত কিছুটা হলেও। কিছুক্ষণের জন্য হলেও।

মাধবপুরী মানুষকে অলৌকিক ক্ষমতায় আকর্ষণ করেননি, করেছেন ভালোবাসায়। মানুষকে অতিমানবিক ক্ষমতায় আসীন করেননি। না তো জীবনের জটিল সব রহস্যের সমাধান করেছেন। শুধু বলেছেন ভালোবাসো, এমন কিছুকে ভালোবাসো সব ছলচাতুরী সরিয়ে দিয়ে যেন সে তোমার আনন্দ হয়, শান্তি হয়, মুক্তি হয়।