আমার একজন পরিচিত, ভাইয়ের বয়সী, অফিস থেকে ফিরে আমায় ফোন করল। কুশল বিনিময়ের জন্য। নতুন অফিস তার। আমায় ফোন করল যখন তখন রাত পৌনে এগারটা। বলল, "অফিসের পরিবেশ খুব ভালো। আমায় ৯ ঘন্টা থাকতেই হবে, তারপর যদি কাজ বাকি থাকে তো সেটা পুরো করে আসতে হবে।"
কথাটা মাথায় গেঁথে গেল। উইকিপিডিয়া খুলে বসলাম। পড়লাম, সাপ্তাহিক কাজের সময়ের সাধারণ গড় হিসাব, ৪৪-৪৫ ঘন্টা/সপ্তাহ, তবে সেটা নাকি ৩৫ ঘন্টা/সপ্তাহ (France) থেকে ১১২ ঘন্টা/সপ্তাহ (North Korea) হতে পারে। থমকে গেলাম।
পরিসংখ্যানের জটিলতায় যেতে চাইছি না। যা বলতে চাইছি, তা আমার আশপাশের নিজের চোখে দেখা, মাথায় গুঁতো মারতে থাকা কিছু চিন্তার ব্যাপারে।
আমি দেখলাম, তারা ন'ঘন্টা কাজ করছে, আড়াই থেকে তিন ঘন্টা যাতায়াত করছে, সাত থেকে আট ঘন্টা ঘুমাচ্ছে। কত হল? ১৯ থেকে ২০ ঘন্টা! বাকি ৪ ঘন্টা কি ৫ ঘন্টা তার নিজের জন্য বরাদ্দ। যে সময়টায় সে দস্তুরমত ক্লান্ত। তার মধ্যে তার পরিবার, বন্ধু-বান্ধব, সন্তান, সামাজিক দায়বদ্ধতার দায়িত্ব। চার থেকে পাঁচ ঘন্টায় তা কি করে সম্ভব? সম্ভব করা হচ্ছে। যাদের স্নায়ুগুলো এই অতিরিক্ত চাপ নিতে পারছে না, তাদের? যাদের উচ্চাকাঙ্খা বা প্যাশন সাঙ্ঘাতিক কিছু অতিমানবিক নয়, তাদের বেলায়?
‘রক্তকরবী’ মনে পড়ে গেল -
‘আমাদের না আছে আকাশ, না আছে অবকাশ; তাই বারো ঘন্টার সমস্ত হাসি গান সূর্যের আলো কড়া করে চুঁইয়ে নিয়েছি একচুমুকের তরল আগুনে (মদ)। যেমন ঠাস দাসত্ব, তেমন নিবিড় ছুটি।'
আজ তাই আমোদ এত মোটা দাগের। যদি বা বিনা তরল গরল পানে কোথাও কাটিয়ে এলাম, হোটেলের কর্তৃপক্ষ অবাক হয়ে জানতে চেয়েছেন, “আপনারা ড্রিংক করেন না! আশ্চর্য!” একবার নয়, বহুবার এই অভিজ্ঞতা বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে গিয়ে হল। আশ্চর্য যত না সেই কতৃপক্ষ হয়েছে আমি হয়েছি তার থেকে বেশি। এমন প্রশ্নও স্বাভাবিক? এটা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ?
এখন মনে হচ্ছে হ্যাঁ, গুরুত্বপূর্ণ বটে। যে স্নায়ুগুলো এই অতিমানবিক চাপ, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর নিয়ে চলেছে তাদের ক্ষেত্রে একে অন্যায় বলা যায় না বোধহয়, যদি না তাদের সুস্থ বাঁচার, সুস্থ recreation-এর সুযোগ থাকে। অথবা নিজের স্বাভাবিক সত্তাকে টিকিয়ে রাখার মত মনের জোর থাকে এর মধ্যেও। সে আলাদা কথা।
ক'দিন আগে ব্যাঙ্গালোর গেলাম এলাম ট্রেনে। তিরিশ ঘন্টার কাছাকাছির যাত্রা। ট্রেনে কমবয়সী ছেলে-মেয়ের অভাব নেই। বেশিরভাগই ছেলে। অবাক হলাম, কষ্ট পেলাম দেখে, তারা পুরোটা পথ হয় ঘুমিয়ে, না হয় মোবাইল বা ল্যাপটপে মুখ গুঁজে কাটিয়ে দিল। মনে হল যেন, এই আশেপাশের বাস্তব জগতটাকে এড়িয়ে চলাটা এমন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে যে, এই ফেসবুক, ওয়াটস অ্যাপের বাইরের দুনিয়ায় পা রাখতে হয় তো বা অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে, অথবা আরো গভীরভাবে হয়তো insecure অনুভব করছে। একবার জানলার বাইরে তাকালো না। এত মনোরম নৈসর্গিক দৃশ্যরা হয় ঘুমে, না হয় ভারচুয়াল জগতে লীন হয়ে যাচ্ছে। এটা কি খুব স্বাস্থ্যকর মানসিকতার লক্ষণ! এভাবে কতদিন? অবসাদ বাড়ছে, অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে, আত্মহত্যার পরিসংখ্যান বাড়ছে। সবার সহ্যশক্তি, লড়াইয়ের শক্তি সমান নয়। তাই প্রতিক্রিয়াও সমান না। তবে কম-বেশি যাই হোক না কেন এর কুপ্রভাবমুক্ত সম্পূর্ণ হওয়া সম্ভব কি?
আরেকটু গোড়ায় আসা যাক। আমি শিক্ষাজগতের সাথে যুক্ত। কি অসম্ভব ক্রমবর্ধমান লোভ শিক্ষাক্ষেত্রে অভিভাবকদের মধ্যে দেখতে পাচ্ছি রীতিমত ভয় লাগছে। লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়ে বড় বড় প্রতিষ্ঠানে এগারো-বারো ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি করে দেওয়ায় হচ্ছে। যারা পারছেন না, অপরাধবোধে ভুগছেন। ছেলেকে বা মেয়েকে যে করে হোক ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার করতেই হবে। সে কি পড়তে চায় বড় কথা না। সে কি হতে চায় বড় কথা না। অবশ্য বাঙালি ছাত্রছাত্রীদের মত এত বাধ্য ছাত্রছাত্রীও কমই দেখা যায় বোধহয়। তারাও ভাল ছেলেমেয়ের মত যুপকাষ্ঠে গলা বাড়িয়ে প্রস্তুত। অবশ্য ক'জনেরই বা সে মনের জোর বা পরিণত চিন্তাভাবনা থাকতে পারে এই বয়সে। তবু অন্য রাজ্যের দিকে তাকালে একটু সংশয় হয় বই কি, আমাদের ছাত্রছাত্রীরা যতই স্মার্ট হোক না কেন, নিজেদের ভবিষ্যতের বেলায় কি খুব বেশি পরনির্ভরশীল নয়? একটু বেশিই অপরিণত নয়? বলার অপেক্ষা রাখে না এর ব্যতিক্রম আছে।
কথাটা হল, আমি যদি পড়ার মধ্যে নিজের আনন্দটা খুঁজে না পাই, শেখার মধ্যে দিয়ে নিজেকে আবিষ্কার করতে না শিখি, তবে ভবিষ্যতে নিজের মত করে বাঁচার মেরুদণ্ডটা তৈরি হয় কি? জানি এটা বলা যত সোজা, করাটা না। তবু বলি, আমি নিজে দেখেছি, যে এই পথে এগিয়েছে সে লড়াইটা শিখেছে। ন'ঘন্টা কেন, বারো ঘন্টা কাজ করেও সে উদ্যমহীন হয় না, কারণ তার সময়টা তার কাছে চুরি হচ্ছে না, অপহরণ হচ্ছে না, অপচয় হচ্ছে না। তা সৃষ্টিশীলতার কাজে লাগছে। সেই ছাত্রজীবন থেকেই সে নিজেকে আবিষ্কার করতে শিখে গেছে। নিজের কাজেই। সেই তার ছুটি, সেই তার সাধনা।
সব শেষে শুরুর সূত্র ধরে বলি, আবার একটা মে ডে হবে কিনা জানি না। তবে এই ট্র্যাফিক, অতিশ্রম এর দুনিয়ায় আটকে কতদিন সুস্থ সমাজ রাখা যাবে তা ভাববার। সংসারে নির্বোধের একটা জন্মগত সুখ আছে, অন্ধের দেশে আলোর প্রতি আস্পৃহা বা না দেখতে পাওয়ার ক্ষোভ নেই, তবু সেটা অমানবিক। সারাদিনে যদি বেঁচে থাকার জন্য চার-পাঁচ ঘন্টা আর বছরে ১৪ টা মুক্তদিনের অবকাশ থাকে তবে সে সমাজের গতি জড়ের গতি। তাতে পুনরাবৃত্তি আছে, গতি আছে, আড়ম্বর আছে - প্রাণ নেই।
আর যে শিক্ষায় শিক্ষার বস্তু শুধুই মই, আনন্দ নেই সে শিক্ষা দিয়ে আবিষ্কার হয় না, নতুনের খোঁজ হয় না, শুধুই শংসাপত্র তৈরি হয়।