আজকের টাইমস অব ইণ্ডিয়ার এডিটোরিয়াল পেজে দুটো আর্টিকেল আছে, হরিয়ানার ঘটনার উপর। দুটো আর্টিকেলেরই মত, এ ধরণের ঘটনা আগে থেকে ঠেকানো যেত, আর দুই প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে আরো কঠোর করার জন্য।
খুব প্রাসঙ্গিকভাবেই সেই একই পাতায় শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সেই অতি উদ্ধৃত উপমাটিও ছাপা হয়েছে, যেখানে শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, একই পুকুরে চারটে ঘাট, একই জল, কেউ বলছে পানি, কেউ জল, কেউ ওয়াটার, কেউ অ্যাকুয়া। বস্তু একই। সব ধর্মই সত্য। সবাই সেই একই ঈশ্বরকে নানা পথে, নানা মতে চাইছে।
রামকৃষ্ণদেব সক্রেটিসের মত রাস্তায় রাস্তায় ঘোরেননি, কিন্তু যে কোনোভাবেই হোক কলকাতার সে সময়ের কিছু তরুণ ও কিছু পণ্ডিত-বিদগ্ধ মানুষকে অবশ্যই আকর্ষণ করেছিলেন। অবশ্য বঙ্গের বাইরে থেকে পশ্চিম থেকেও কেউ কেউ এসেছিলেন ওঁর কাছে।
কিন্তু কথা হচ্ছে শ্রীরামকৃষ্ণ উপলব্ধ ধর্ম আর সাধারণের বোধের ধর্ম কি এক? দাঙ্গার উৎস কি ধর্ম, না ঘৃণা?
চৈতন্যদেবের জীবনী লিখতে গিয়ে কৃষ্ণদাস কবিরাজ লিখছেন, "ঈশ্বরত্বে ভেদ মানিলে হয় অপরাধ"। নানক, কবীর সব এক কথাই তো বারবার বলে গেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের প্রায় সমসাময়িক শিরডির সাঁইবাবার জীবনীতেও একই দর্শন। এমনকি ওঁর জীবনীতে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গাও উনি থামিয়েছেন, এও প্রামাণ্য তথ্যও আছে। তবে?
আসলে আমাদের বাণীর অভাব নেই, মহাত্মার মত মানুষের নানা ঘটনার উদাহরণেরও অভাব নেই। অভাব আমাদের সদিচ্ছার। অভাব আমাদের মূঢ়তার থেকে বেরোনোর স্ব-শিক্ষার প্রতি আগ্রহের। অভাব আমাদের সঠিক শিক্ষার। নইলে বাণী আছে, উদাহরণ আছে, আর কি চাই? উপায় তো আছে! এমন কোন সামাজিক সমস্যা আছে যার সমাধানের জন্য কোনো না কোনো উপায় নেই? রবীন্দ্রনাথ, মহাত্মা তো কোনো জটিল তত্ত্বের রাস্তা দেখাননি, সহজ শিক্ষার রাস্তা দেখিয়েছেন। কিন্তু সে আমাদের রক্তে মিশল না কেন?
কারণ আমাদের বিদ্বেষের ভাব যতটা গভীরে বাস করে, শিক্ষার আলো হয় তো অতটা গভীরে যায় না। শিক্ষাকে হয় তো আমরা শুধুমাত্র বাহ্যিক বৌদ্ধিক অলঙ্কারের বেশি ভাবতে পারি না। নইলে পাশ্চাত্যে এত আইনকানুন শিক্ষার উন্নয়নের পরেও কেন সাদা কালোয় এত দ্বন্দ্ব? প্রায়ই অমন পাশবিক অত্যাচারের কথা কেন পড়তে হয়? দিন যত বাড়ছে সেখানেও সাদা কালোর দ্বন্দ্ব বাড়ছে। কর্নেল ওয়েস্ট, নোম চোমস্কি, মার্থা ন্যুসবাম প্রভৃতি মানুষের কথায় উঠে তো আসছে।
মানুষের মধ্যে এক আত্মধ্বংসী ক্ষমতা আছে। কিন্তু তার গভীরে তার একটা জন্মগত নৈতিক বোধও তো আছে। দুটোই প্রমাণিত। এখন আমাদের সামনে রাস্তা দুটো, কিন্তু দেখার হল আমার চারপাশের পরিবেশ কোনটাকে বেশি উৎসাহিত করছে?
বিদ্বেষকে চালিকাশক্তি হতে গেলে একটা উন্মাদনার দরকার। ইন্ধন জোগানের জন্যে গুজব অথবা ভুয়ো খবর, বৃহৎসংখ্যার দলবদ্ধতা, অস্ত্রের যোগান, কোথাও কোনো বৃহৎশক্তির সমর্থন…. এর একটা বা দুটো বা বেশ কয়েকটা তো কাজ করেই।
তারপর শুরু হয় রাজনৈতিক তর্জা। সমস্যা হল গণতন্ত্র অনেক সময়েই দলতন্ত্রের প্রতি আনুগত্যে এসে ঠেকে। গণ - যে নিরপেক্ষভাবে, জনকল্যাণের দিকে তাকিয়ে কথা বলবে, সে-ই গণ নানাভাবে নানা দলীয় মতের আদর্শের প্রতি বিচার-চিন্তাহীন অভ্যাসগত আনুগত্যে নিজেকে ভাসিয়ে দেয়। ফলে সত্য থেকে যায় অধরা, নানা হাফ-বেকড তত্ত্ব, একে অন্যকে দায়ী দোষী ইত্যাদির আবর্তে আইন-শৃঙ্খলার দিকে না এগিয়ে মিডিয়া ট্রায়াল, সোশ্যালমিডিয়া ট্রায়ালে ঢুকে যায়। পোস্টট্রুথের মত গরল উৎপন্ন হয়। সেই গরল অপসারণ করতে আবার আরো সময় বয়ে যায়।
তবু অবশেষে সমাজ তো সাধারণ মানুষেরই। তাই সাধারণ সরল সত্য একদিন আবার নানা কুয়াশা, ঘূর্ণি সরিয়ে দেখা দেয়, আবার মানুষ নিজের ভুল উপলব্ধি করে, আবার কিছুটা আত্ম-মার্জনের রাস্তায় হাঁটে।
মানুষের মূলগত প্রকৃতিতে শান্তিতে, সংহতিতে বেঁচে থাকার এক নৈতিক ঝোঁক আছে। কিন্তু সেই প্রকৃতির বিপরীতে রীতিমতো ক্ষেপে ওঠারও ক্ষমতা আছে। কিন্তু সে তো তার স্বাভাবিক অবস্থা নয়। সাধারণ মানুষ যখনই নিজের এই আত্মবোধে জেগে ওঠে তখনই সে আবার শান্তি - সংহতির রাস্তায় হাঁটে, যে তাকে এই রাস্তায় নিয়ে আসে তাকে সে শান্তভাবে বিনা কোনো ক্ষুদ্রস্বার্থের প্ররোচনায় অনুরসরণ করে। কিন্তু যখনই সে নিজের আত্মবোধ থেকে বিচ্যুত হয় তখনই সে নানা আসুরিক প্রবৃত্তির খপ্পরে পড়ে, এবং আসুরিক প্রবৃত্তিতে মত্ত মানুষের অধীনে এসে পড়ে। ক্রমে উন্মাদ হয়ে ওঠে।
নিজেকে রক্ষা করার তাই প্রাচীনতম রাস্তা সেই এক, আত্মবোধের জাগরণ। যা সেদিন প্রাচ্যের উপনিষদে লেখা হয়েছিল, পাশ্চাত্যের ডেল্ফির মন্দিরে লেখা হয়েছিল - নিজেকে জানো।
সাধারণ মানুষের আত্মবোধের জাগরণই সঠিক সুষ্ঠু গণতন্ত্রের ভিত্তি। বৈচিত্রের মধ্যে সংহতি গড়ে ওঠার প্রেরণার উৎসই হল এই আত্মবোধের চর্চা। যে কথাটা সেই প্রাচীন যুগ থেকে আধুনিক যুগের মহাপুরুষদের একটাই শিক্ষা - তোমাদের চৈতন্য হোক।
এ দীক্ষা সাধারণ মানুষের আত্মবোধ জাগানোর জন্যেই তো। আর উপায় কি? সাধারণ মানুষের হাতেই তো আইন থেকে সমাজ সবটুকু। নিজে না জাগলে, নিজে অন্ধ হয়ে থাকলে কে কাকে পথ দেখাবে? শুধু কোলাহলই সার হবে যে!