Skip to main content

 

প্রাণের মানুষ আর কাজের মানুষ। কাজের মানুষ দরকারের মানুষ। সে দরকার যতই কিনা গুরুত্বপূর্ণ হোক, তার একটা মেয়াদ আছে। কিন্তু যে প্রাণের মানুষ সে যতই কিনা অকাজের হোক, গোলমেলে হোক, যন্ত্রণাদায়ক হোক না কেন, তার মেয়াদ আর ফুরোবার নয়। অনেক মায়েরা যেমন ভীষণ জ্বালাতনকারী সন্তানকে 'পেটের শত্রু' উপাধিতে ভূষিত করেন, এও তেমন।

এই যেমন ধর্ম দিয়েই শুরু করা যাক। এই যে এত এত অবতার, গুরু, মন্দির ইত্যাদিকে অনেকে আমরা প্রাণের সঙ্গে জুড়িয়ে রাখি, নাস্তিকেরা আবার যেমন নানা রাজনৈতিক দার্শনিক, নেতাদের ফটোতে মালা দিয়ে প্রায়ই ভালোবাসা জানান, এতে দোষের কিছু আছে? নেই। কিন্তু যে প্যারাসিটামল আবিষ্কার করেছিল, কি সেফটিপিন, কি মোটর সাইকেল, কি ওয়েবসাইট, কি কণ্ডোম, কি রান্নার গ্যাস, কি কমোড ইত্যাদি আবিষ্কার করেছিল, তাদের নাম কেউ আমায় জিজ্ঞাসা করুক দেখি, অমনি গুগুল খুলে খুঁজতে হবে। সেও যেনা আজকাল গুগুল আছে বলে। আগের দিন হলে সিধু জ্যাঠাকে খুঁজে বার করো। অথচ দেখো রাতদিন এদের নিয়েই বেঁচে থাকা।

তবে কি মানুষ অকৃতজ্ঞ? একদিক থেকে হ্যাঁ হলেও, গোটা দিক থেকে না। যে চিকিৎসক আমায় কঠিন রোগ থেকে বাঁচালেন তাকে ভুলতে বেশিদিন লাগে না। কিন্তু কোনো এক কবিকে স্মরণ করে হয় তো মাঝে মাঝেই আমি বিগলিত হই।

এর কারণ একটা আছে। মানুষের কাজ, প্রয়োজন, একটা সীমায় আবদ্ধ। মানুষের অনুভব তো নয়। কাজের মানুষ তাই আমাদের বৈঠকখানা অবধি এসেই, আমার নানাবিধ সৎকারে, আপ্যায়নে, তাৎক্ষণিক কৃতজ্ঞতায়, আবেগে যা পাওয়ার পেয়ে চলে যান। কিন্তু প্রাণের মুগ্ধতা তো অন্দরমহল ছাড়া পাওয়া যায় না। কিন্তু অন্দরমহলে আসবে কে?

বাঙালি একদম প্রফেশনালিজম বোঝে না। সব ক্ষেত্রেই সে দাদা-কাকা-মেসো-পিসে বানাতে চায়। সে ভালো ব্যবহারকারী ডাক্তার, ব্যাঙ্কের ম্যানেজার, অফিসের বড়বাবু, হাসিমুখ টিকিট চেকার - এইসব খুঁজে বেড়ায়। কাজটার চাইতে ভালো ব্যবহারের ওপর টান তার বেশি। তাই ঠকেও বেশি। ঠকায়ও বেশি। তবে এ নয় যে শুধু ব্যবহারেই, কাজেও ঠকেছে এমন উদাহরণও আছে। সে অন্য প্রসঙ্গ।

এখন কথা হল, সংসার কাজের জায়গা না ভাব-ভালোবাসার জায়গা, এই নিয়ে মেলা বিতর্ক আছে। কি একটা শ্যামাসংগীত আছে, "পৃথিবীর কেউ ভালো তো বাসে না, এ পৃথিবী ভালোবাসিতে জানে না, যেথা আছে শুধু ভালোবাসাবাসি সেথা যেতে প্রাণ চায় মা"। এখন এরকম একটা স্থান মায়েরও জানা আছে বলে আমার বিশ্বাস হয় না। সেখানেও তো দেবতাদের কোন্দল, অসুরদের উৎপাত কম নয় বাবা!

তবে কাজের মানুষ হয়ে থাকা আর কাজের মানুষদের নিয়ে চলাতেই কম হ্যাপা দেখি। ও ভালোবাসাবাসি হলেই যত ঝামেলা। মান অভিমান এসবের হাজার একটা ফ্যাঁকড়া সামলাও। কাজের মানুষের খারাপ কথা, কাজের মানুষের দ্বিচারিতা, কাজের মানুষের ঠকানোর ইচ্ছা - এ সবই সয়ে যায়। প্রাণে লাগার কোনো দায় নেই। বরং যেই আপনি কারোর প্রাণের মানুষ হতে গেলেন অমনি আপনাকে বাগে পেয়ে সে আপনাকে যে তার কাজের মানুষ করে তুলবে না এ কথা কেউ দিতে পারে না। 'শ্যামা' নাটকটা মনে নেই? বেচারা উত্তীয়'র কথাটা ভাবুন। শ্যামা ভালোবাসল বজ্রসেনকে। কিন্তু ভালোবাসলে কি হবে, সে তো মিথ্যা চুরির দায়ে ফেঁসেছে। তাই শ্যামার মন উচাটন। এদিকে উত্তীয় শ্যামার প্রাণের মানুষ হওয়ার জন্য পাগল। ব্যস, শ্যামার কাজের মানুষ হয়ে গেল সে, বজ্রসেনের দোষ নিজের ঘাড়ে নিয়ে প্রাণটা দিল বেঘোরে। কাজে লাগালো কে তাকে? না সেই শ্যামা! হায়, "হেথা সুখ ইচ্ছ মতিমান?"

শাস্ত্র বলে সংসারে নিজেকে কাজের মানুষের বেশি আর উঠিও না। ওসব ভালোবাসাবাসির চক্কর ছাড়ো। শেষে সব একগাল মাছি হবে। তখন সবাই আমায় ধোঁকা দিল, কেউ আমায় বোঝে না, সবাই অকৃতজ্ঞ, বেইমান - এইসব বস্তাপচা কথাগুলো বলে জগত হেদিয়ে বেড়াবে। এই নিয়ে মেলা মেলা দার্শনিক বই লেখা হয়ে গেল। রোমান্টিক সিনেমাগুলো দেখো না, ওইজন্য বিয়ের পর আর এগোয় না। তবে তো আবার প্যারালাল সিনেমা বানিয়ে ফেলতে হবে। দর্শক কই তার? ক'টা পুরষ্কার আর ক্রিটিকের ভরসায় সবাই কি আর সিনেমা বানায় বাছা?

কেউ কেউ আবার এই ঝক্কি সামলাতে অমানুষী বা ফটোমানুষীকে প্রাণের মানুষ করে ফেলে। কেউ কুকুর-বেড়াল, কেউ বাগান-বই, কেউ দেবতা-গুরু-অবতার, কেউ ডুগি-তবলা, আঁকা-নাচা-গানকে প্রাণের মানুষ করে। বললে বলে, আমি এই নিয়েই আছি, বেশ আছি। মায় বিদ্যাসাগরকে দেখুন। আজকাল তো দেখি অনেকেই বিদ্যাসাগরের ওই কার্মাটাড়ের জীবনের উপর বই লিখছেন। লোকে আসলে বুঝছে, বিদ্যাসাগর যা করেছেন, তার চাইতে ঢের সত্য যা করতে পারেননি। তাই ওদিকে মানুষে টান বেড়েছে আজকাল এত।

যা হোক, লেখা অনেক দূর গড়ালো। আর বেশি কথায় কাজ নেই। প্রাণের মানুষ লালন খুঁজে পায়নি যখন আমাদেরও বিটা ভারসান নিয়েই কাজ চালাতে হবে এটা মেনে নিলেই ভালো। "তুমি আমার আমি তোমার" - এর একটা এক্সপায়ারি ডেট থাকে। কিন্তু সংসারে কাজের আর শেষ থাকে না। তাই বৃন্দাবনে কৃষ্ণের লীলার দিন শেষ হয়, কিন্তু হতভাগা, বাড়ি খেদানো বিধবাদের দরকার আর শেষ হয় না। এক মুঠো চালের জন্য সারাদিন নামসঙ্কীর্তন করে তবে বেঁচে থাকে। নইলে মরতে হবে। এই নিয়ম। কঠিন। কিন্তু সত্য। বাকি সব মায়া হে নন্দলাল।