Skip to main content
হে কর্ণধার

রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিখ্যাত ‘সাধনা’ গ্রন্থের ভূমিকায় বিশ্ববাসীর উদ্দেশ্যে নিজের ধর্মবোধ বলতে গিয়ে একটি জায়গায় বলছেন – 'উপনিষদ ও বুদ্ধের বাণী, শাশ্বত আত্মার বাণী, যা অসীমের পথে বিকাশের প্রেরণা। আমি নিজ জীবনে তা অনুসরণ করেছি, ও সেই বাণীই প্রচার করে এসেছি সারা জীবন...'

এমন স্পষ্ট করে তিনি তাঁর ভাবের গঙ্গোত্রীর পথ খুলে দিলেন। ‘এসো স্পর্শ করে যাও’ বলে আহ্বানও জানালেন। যেন বলছেন, তারপর ভালো লাগলে নিও, না হলে ফেলে যেও।
আজ বাইশে শ্রাবণ। এই কথাটা ঘুরে ফিরে মনের মধ্যে বাজছে। তাই এ লেখা লিখতে বসা। একটা ব্যক্তিগত কথা এখানে বলে নিই, এই বলার পিছনে কোথাও আত্মজাহির করা, বা সমাজ উদ্ধার করা, বা গুরুগিরি করার মতলব আঁটছি এমন ধারণা যেন কেউ অনুগ্রহ করে না করেন। বন্ধুরা বাড়িতে এলে ভালো খাবারটা, ভালো বসার জায়গাটা, ভালো পোশাকটা দিতে যেমন ভালোবাসি, এক্ষেত্রেও তাই, নিজের ভালো চিন্তাটা যা আমায় ভালো রেখেছে তাকে এগিয়ে দিতেই ভালোবাসি। ব্যস আর কিছুর জন্য না। তার জন্যই লিখতে বসা।
রামকৃষ্ণদেব বলছেন, ‘শাস্ত্রের সার কথাটা গুরুমুখে শুনে নিতে হয়, তা হলে অসার ভাগটা আর চিন্তা করতে হয় না।‘ ঠিক তাই। উপনিষদ বা ত্রিপিটক সম্পূর্ণ পড়ে তার মর্মোদ্ধার করা বা রসবোধ করার মত ক্ষমতা আমাদের মত সাধারণ মানুষের কোথায়? তাই আমাদের গুরুদেবকে দরকার। খুব দরকার। যিনি সারভাগটা বলে দেবেন। আর এমন গুরুদেব ছাড়া কার মুখের দিকেই বা তাকাব? যিনি শুধু গান লেখেন না, গানগুলো পর্যায়ক্রমে সাজিয়ে একটা গীতবিতানও বানিয়ে দিয়ে যান আমাদের জন্য।যাতে মনের অবস্থার ভাব অনুযায়ী ঠিক গানটা খুঁজে পেতে বিলম্ব না হয়। নিজের ধর্মবোধ তথা জীবনবোধকে ‘শান্তিনিকেতন’ গ্রন্থে (যা শান্তিনিকেতনে ছাত্রদের উদ্দেশ্যে পাঠ করতেন), সেটিকেও অতি সংক্ষিপ্ত করে ‘সাধনা’ বইয়ের অন্তর্গত করে রেখে গেলেন বিশ্ববাসীর জন্য।তাঁর সারা জীবনের শ্রেষ্ঠতম উপলব্ধির সারাংশ।
উপনিষদে বিবেকানন্দ দেখলেন ‘অভীঃ’ মন্ত্র। ত্যাগের মাধ্যমে আহ্বান করলেন সে পথে। রবীন্দ্রনাথ দেখলেন ‘আনন্দ’- মন্ত্র। সুখে-দুঃখে স্থির থেকে আনন্দকে অনুভব করার পথ। কি সে তপস্যার পথ? বললেন, শান্তম শিবমদ্বৈতম।এই মন্ত্রে দীক্ষা দিয়ে বললেন, সর্বপ্রথম শান্ত হও। কি করে হব? বললেন, শোনো উপনিষদের ঋষিদের বাণী – মা গৃধঃ – লোভ কোরো না।
শান্ত হলে পাবে শিবকে। শিব অর্থে মঙ্গল। পাবে মঙ্গলের পথকে। মহাত্মা রমণ মহর্ষির কথা মনে হল। তিনি বলতেন, 'পৃথিবীর সব ধর্ম, দর্শন শিক্ষার একটাই লক্ষ্য – শান্ত হও।'
তাই বলা হল মঙ্গলের পথকে পাবে। সেই মঙ্গলের মধ্যে সবাইকে দেখবে একসূত্রে - অদ্বৈতে। কারণ মঙ্গল 'এক'-এর মধ্যে। একজোট হওয়াতে নয়, একবোধ হওয়াতে। এই হল উপায়। এরমধ্যেই আছে সে আনন্দধামে যাওয়ার, নিজের আনন্দস্বরূপকে অনুভব করার পথ। বারবার তিনি মনে করাচ্ছেন উপনিষদের ইঙ্গিত - 'এ বিশ্বচরারচর আনন্দ হতে জাত।' যে আনন্দ শাশ্বত, চিরজাগ্রত, চিরগুহায়িত। গুহায়িত অর্থে হৃদিকন্দরগত। মৈত্রেয়ীদেবীকে এক জায়গায় বলছেন, যখনই মন উদ্বিগ্ন হবে, চঞ্চল হবে, মনে মনে আবৃত্তি কোরো – আনন্দম পরমানন্দম পরম সুখম পরমাতৃপ্তি!
কিন্তু এ তো গেলো ধ্যানের মন্ত্র। এই কর্মজীবনে? কি করে এ ভাবকে ধরে চলব? কিভাবে প্রকাশিত হবে এ ভাব কাজে? রবীন্দ্রনাথ দাঁড় করালেন বুদ্ধের সামনে। বুদ্ধের সব বাণী মন্থন করে কি মূলমন্ত্র দিলেন? বললেন, 'মৈত্রী ভাবনা'। দুঃখকে চরম বলে জানা বুদ্ধের চরম বাণী না। জীবনকে কেটেছেঁটে অতি সরল করে প্রাণসাগরে পাড়ি দেওয়ার পক্ষপাতিত্ব রবীন্দ্রনাথ করেননি কোনোদিন। তাতে মানুষের মহত্বের প্রতি অবমাননা করা হয়। বললেন, বুদ্ধের মর্মবাণী শুধুই যদি ত্যাগের কথা, জীবন থেকে সরে আসার কথা হত, তবে তো বলতে হয় বুদ্ধ একটা পবিত্র আত্মহত্যার পথ বলেছেন।'
তা তো না। তিনি অপরিমেয় মৈত্রীর কথা বলেছেন। (যার বর্তমান ইংলিশ হল – Loving kindness. জানি না সেটা কতটা ঠিক অনুবাদ, তবু আজ এই কথাটা সারা বিশ্বে নিনাদিত তো হচ্ছে! )। আরো বললেন, 'সংসারের প্রবল অন্ধকারের দিনগুলোতে দাঁড়াও মহৎ জীবনগুলোর সামনে। তাঁদের জীবন কি প্রতিমুহুর্তেই লোকসমাগমে পরিপূর্ণ? উৎসবমুখরিত? না তো।এই মহৎ জীবনগুলোর প্রতিটা দিন-রাত্রি কি কঠোর, কি অসহ্য যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে কেটেছে। বারবার হতাশা, বিশ্বাসঘাতকতা এসে পথ অবরোধ করেছে। নীরবে সহ্য করেছেন। হেঁটে গেছেন অমৃতত্ত্বের দিকে, কারোর প্রতি বিদ্বেষ না রেখে। তুমি অনুপ্রাণিত হও। নিজেকে তৈরী করো। জীবনের পথের দুর্গমতার কাছে হেরে যেও না।'
এরকম কিছু কথাতেই মনটা ভরেও আজ, উদাসও আজ। যত দিন যাচ্ছে তত মনের উদাস ভাবটা কমছে। বাইশে শ্রাবণ শুধু চোখের জলের দিন না, এই দিনটাতেই নিজেকে দিয়ে বলিয়ে নিতে হবে - দুঃখের কাছে, ক্ষুদ্রতার কাছে, অসত্যের কাছে হেরে যাওয়ার জন্য এ জীবন না। গীতবিতানের থেকে বড় ধর্মগ্রন্থ কি আছে আমাদের জীবনে যাদের রবীন্দ্রনাথ ছাড়া বেঁচে থাকার অর্থ নেই। তাই সে মুখের দিকে তাকিয়েই গাই –

আনন্দ তুমি স্বামী, মঙ্গল তুমি,
 
তুমি হে মহাসুন্দর, জীবননাথ ॥
শোকে দুখে তোমারি বাণী জাগরণ দিবে আনি,
নাশিবে দারুণ অবসাদ ॥
চিত মন অর্পিনু তব পদপ্রান্তে--
শুভ্র শান্তিশতদল-পুণ্যমধু-পানে
চাহি আছে সেবক, তব সুদৃষ্টিপাতে
কবে হবে এ দুখরাত প্রভাত ॥

 

(ছবিঃ সমীরণ নন্দী)
[বইয়ের লিঙ্কঃ SADHANA : The Realisation Of Life]
{গানের লিঙ্কঃ আনন্দ তুমি স্বামী, মঙ্গল তুমি - ঋতু গুহ}