Skip to main content


"জীবের আত্যন্তিক মঙ্গল কিসে?".... "হ্যাঁ গো, কাল কি দুধে বেশি জল মিশিয়েছিলে নাকি ?"
দুটোই প্রশ্ন। প্রশ্ন কোথায় নেই? সেই গীতায় অর্জুনের প্রশ্ন... বাইবেলে যোহন, ম্যাথিউ ইত্যাদির প্রশ্ন... বুদ্ধকে আনন্দ, আম্রপালির প্রশ্ন... সক্রেটিসকে প্লেটোর প্রশ্ন... অধুনা কথামৃতে ঠাকুরকে স্বামীজি থেকে গিরিশের অবধি নানান প্রশ্ন।
এতো গেল দর্শনের কথা। এছাড়া ছাত্রের প্রশ্ন, পার্লামেন্টের প্রশ্ন, প্রতিবেশীর প্রশ্ন, প্রেমিকের/প্রেমিকার প্রশ্ন.... প্রশ্নে প্রশ্নে ছয়লাপ।
কথা হল, সব প্রশ্নই কি একই গোত্রের? অতি বড় গর্দভেও বলবে না সে কথা। আমি যে কথা বলতে এ প্রসঙ্গের অবতারণা করেছি সেটা হল, প্রশ্নের দুই ধারা খোঁজার জন্য।
প্রশ্নের উদ্দেশ্য কি? জানার ইচ্ছা। সে জানার ইচ্ছার অবশ্যই তারতম্যতা আছে। শুরুর উদাহরণ দুটো তার চূড়ান্ত উদাহরণ ধরা যেতে পারে। তবে তা নির্দোষ প্রশ্ন।
তবে কি প্রশ্নও দোষদুষ্ট হয়? সে কথাতে পরে আসছি। আমার প্রশ্ন'র ব্যাপারে আলোচনার পরিসরটা খুব বড় না। যে প্রশ্ন তাত্ত্বিক, যে প্রশ্নের 'হাঁ' বা 'না' এ উত্তর হয় না, সেই নিয়ে কথা বলার ইচ্ছা। অর্থাৎ প্রথম জাতের প্রশ্ন যা শুরুতেই বলা হয়েছে।
গীতায় একটা কথা আছে, 'পরিপ্রশ্নেন'। এই একটা শব্দেই যা বলতে চাই তার ইতি টানা যায়। কি অসাধারণ উক্তি!
একদিন শিরডির সাঁই তাঁর এক শিষ্যকে এই শ্লোকটির অর্থ বোঝাচ্ছেন। যেই এই শব্দটি উচ্চারিত হল, অমনি সাঁই বললেন, "পরিপ্রশ্নেন মানে কি"? শিষ্য বললেন, "প্রশ্ন করা"। সাঁই হেসে বললেন, "তবে ব্যাসদেব মাঝখান থেকে 'পরি' শব্দটা জুড়লেন কেন?"
শিষ্য নিরুত্তর।
সাঁই বললেন, 'পরিপ্রশ্নেন' মানে - শুদ্ধ মনে প্রশ্ন করা। গুরুকে পরীক্ষা করা, বা প্রশ্নের প্যাঁচে ফেলে তাকে জব্দ করার চেষ্টা ইত্যাদির থেকে নিরত থেকে, নম্রভাবে প্রশ্ন করা।
ঠিক তাই। শঙ্কর থেকে অধুনা গীতা ভাষ্যকার স্বামী রামসুখদাসজীর ব্যাখাও তাই। প্রশ্ন হোক নির্দোষ, অকপট, জানার গভীর আকুলতা থেকে। যা অনায়াসেই নম্র করবে প্রশ্নকর্তাকে।
এই হল কথা। কিন্তু সে জানার তৃষ্ণা জাগাও তো এক পরম ভাগ্যের কথা। তার চাইতে চারটে চটুল প্রশ্ন করে, শব্দের মারপ্যাঁচ খেলে খানিক বিদ্যাজাহির করে অহং তুষ্টিতেই তো আমোদ বেশি। অগত্যা প্রশ্নের মানও সেই গোত্রের হয়। সে প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে যে প্রশ্নকর্তারই অপমান, সে বোধটুকু তো প্রশ্নকর্তা অহংমদে বিস্মৃতপ্রায়। তার বুঝ হল - 'সব মানুষ সমান। অর্থাৎ আমি যতটা বুঝি তুমি ব্যাটা তার থেকে বেশি বোঝো কি করে? আমি যতটা অনুভব করি তুমি ভণ্ড তার থেকে বেশি অনুভব করো কি করে? আমার জানার, অনুভবের বাইরে যা কিছু সব মিথ্যা।' এমনটাই সে মদমত্ত প্রশ্নকর্তার ধারণা।
তবে কি সে খুব উদ্ধত? না মোটেই না। এখানে আরো চাতুরী। সে একদম বিনয়ের অবতার, না তো সত্যবাদী যুধিষ্ঠিরের অনুজ। হয় বলবে, "আমি ভাই নরাধম, কিছুই বুঝি না, তবু বলো এটা যদি এটা হয় তবে ওটা তবে সেটা নয় কেন? আর দ্বিতীয় পক্ষের বুলি হল, "আমি যা বলি স্পষ্ট বলি, ওসব ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলা আমার ধাতে সয় না, বলতে হলে বলো, না হলে বোলো না। এটা যদি ওটা হয়, তবে সেটা ওটা হবে না কেন?"
নাও বোঝাও। যদি উত্তর দাও, আবার প্রশ্ন। কারণ তার মূল উদ্দেশ্য তো প্রশ্ন করা না, প্রশ্নের ফাঁদ তৈরী করা। তাই তুমি তা কেটে বেরোলে যে তার সব চেষ্টায় জল পড়ে গেল। সক্রেটিস এহেন লোকেদের খুব এড়িয়ে চলতেন। বলতেন, সফিস্ট। ভাবুন, যে মানুষটা সারাদিন প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে লোককে জেরবার করতেন, তিনিই এড়িয়ে যেতেন। কারণ ওই এক। এ ধারার প্রশ্নের পিছনে তৃষ্ণা নেই, আছে অহং-এর ঈর্ষারূপী তপ্ত কুণ্ড।
তাই বলছিলাম, তত্ত্বগত প্রশ্ন করবার জন্য আগে একটা পূর্ব সাধন থাকা চাই। সে একটা জীবন মরণ সমস্যা হয়ে দাঁড়ান চাই। তবে তার সঠিক উত্তর আসে, ও সঠিক উত্তরদাতা প্রভুর ইচ্ছায় জোটে। না হলে সবই ফাঁকি। সম্বল শুধু বুলি!
প্রার্থনা করি সে প্রশ্ন চিত্তে জাগুক। সর্বগ্রাসী, আকুল সংশয় আসুক। মন অকপট তৃষ্ণার্ত হোক, নিছক কৌতূহলী না। তবে সে পরম মুহুর্ত আসবে জীবনে।
"দরজায় করাঘাত করো, দরজা খুলে দেওয়া হবে" - বাইবেল
"প্রার্থনা আন্তরিক হলে তিনি শুনবেনই শুনবেন" - শ্রী রামকৃষ্ণদেব