Skip to main content

        তো সুপ্রীম কোর্ট বলল মেয়েরাও মন্দিরে ঢুকতে পারবে। আহা, আমাদের কালীঘাট, দক্ষিণেশ্বর, তারকেশ্বরের কথা হচ্ছে না, সে দক্ষিণভারতের কি এক সবরীমালা মন্দিরের কথা। আমাদের বাপু অমন ধারা শক্ত নিয়ম কোনো বড় মন্দিরে দেখি নাই। বাঙালী মাত্রেই মা অন্তঃপ্রাণ জাত। এই শুরু হচ্ছে দেবীপক্ষ, দেখুন না সপরিবার দূর্গা, তাতে দুইজন মা, লক্ষী-সরস্বতী, আবার লক্ষ্মী, তারপর কালী, জগদ্ধাত্রী ইত্যাদি মায়ের পর মা। তার সাথে মঙ্গলচণ্ডী, বিপত্তারীণি ইত্যাদি তো আছেই। তার সাথে এখন আনন্দময়ী মা, মা সারদা, গৌরী মা এরকম অনেক মানবী মায়েরাও আছেন। সুতরাং মোদ্দা কথা আমরা মাতৃগত জাত। আমাদের উঠতে বসতে চলতে ফিরতে 'মা মা' ডাক। পাড়ায় পাড়ায় কালীমন্দির। এমনকি বাংলার বাইরেও কালীবাড়ি মানেই বাঙালিপাড়া। তাই আমাদের ওসব নিয়ে মাথা ঘামানো নেই। মন্দিরে মেয়েরা ঢুকতে পারবে না, এ আবার কি বেয়াড়া কথা বাপু, তার জন্য মোকদ্দমা করা লাগে? 
        আমি হালিশহরে থাকি। রামপ্রসাদের মায়ের মন্দির তো আছেই, সাথে আবার পাশেই রাসমণির ভিটে। তার সাথে সিদ্ধেশরী কালী মন্দিরও খুবই প্রসিদ্ধ। অর্থাৎ কিনা মায়ের জায়গা। এবার কথা হল এই মাতৃসাধনা বাঙালীকে কি দিয়েছে। গান দিয়েছে, মন্দির দিয়েছে, কয়েকজন খ্যাতনামা মাতৃসাধক দিয়েছে, তার সাথে সতীদাহ, বিধবা নির্যাতন, বধূনির্যাতন, নারীশিক্ষায় বিরোধীপক্ষ হওয়া ইত্যাদি ইত্যাদিকে উপেক্ষা করে যাওয়ার ক্ষমতাও দিয়েছে। মজার কথা হচ্ছে বাঙালি মেয়েদের কথা যারা ভাবলেন, তাদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে যারা সোচ্চার হলেন, তারা কিন্তু কেউ মাতৃসাধক নয়। না রামমোহন, না বিদ্যাসাগর। একমাত্র ভাবলেন কে? নিবেদিতা। তিনি সাধিকা হিসাবে ততটা ভাবেননি, যতটা সমাজসংস্কারক হিসাবে ভেবেছেন। তাতে যদি মনে করা হয় যে সময় বিবেকানন্দের পর রামকৃষ্ণ মিশনের ব্রহ্মাজ্ঞানী, মাতৃসাধক রামকৃষ্ণের শিষ্যরা নিবেদিতাকে খুব একটা সাহায্য করেছিলেন, তাও নয়। তখন মা সারদা ইতিমধ্যে দেবী হিসাবে পূজিতা, প্রতিষ্ঠিতা, সন্ন্যাসীবৃন্দ সেই নিয়ে ব্যস্ত। বড় করে দূর্গাপূজা হচ্ছে, আরো নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠান হচ্ছে, মাঝে মাঝে সেবা হচ্ছে, বড় বড় ভাষ্য লেখা হচ্ছে, বক্তৃতা দেওয়া হচ্ছে, মেয়েদের মঠ প্রতিষ্ঠা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আদতে সমাজে মেয়েদের অবস্থান নিয়ে নড়ে চড়ে বসার কথা আসছে ঠাকুরবাড়ি থেকে। শান্তিনিকেতন থেকে। আজ সেই প্রতিষ্ঠান থেকে যতগুলো কৃতী মানুষ আমরা পেয়েছি নানা দিকে সেই সন্ন্যাসী মহল থেকে কোথায়? কারণ ধর্ম আমাদের তাকিয়ে অন্ধ থাকতে শেখায়, শিক্ষা নয়। আজও মিশনের যতগুলো বড় বড় নামকরা স্কুল কলেজ সে সব পুরুষের জন্য, মহিলাদের জন্য নয় কিন্তু। 
        এইখানেই সবরীমালার কথা। মেয়েরা মন্দিরে ঢুকতে পারবে না, এতবড় একটা অপমানজনক কথা মানুষ ভাবতে পেরেছিল আর এত বছর ধরে সেই প্রথা টিকিয়ে রাখা হয়েছিল, এ একটা খুব বড় আশ্চর্য কথা। কতটা অন্ধকার মনে জমে থাকলে বাইরের এতবড় অন্ধকারটা মানুষের চোখে সয়ে যায় ভাবতে অবাক লাগে। মনুষ্যত্ব আর ধর্মের সম্পর্ক অনেকটা বৃষ্টি আর বন্যার মত। ধর্মে মনুষ্যত্বের কথা বারবার আসে, বৃষ্টির কপট আশ্বাসেই যেমন বন্যা আসে তার মত, কিন্তু অবশেষে সে যা আনে তা দুর্যোগ। আসলে আমি যা বলতে চাই তা হলে অনেক জায়গাতেই আমরা এখনও বিশ্বাস করি মেয়েদের অনেক জায়গায় ঠাঁই নেই, ঠাঁই নেই বলতে হয়। নরেন্দ্রপুর, রহড়া, শিল্পমন্দির ইত্যাদি নানা অত্যন্ত উন্নত মানের পঠন-পাঠনের খ্যাতি যেখানে সেখানে মেয়েরা ঢুকতে পারে না, পড়তে পারে না। এটা কি সবরীমালার থেকে আরো বেশি ভয়ংকর নয়? সেখানে তো না হয় ধর্মের কথা, কিন্তু এখানে যে বিদ্যার কথা। এতো বিশ্বাসের কথা নয়, কিন্তু একটা অন্ধতার কথা। যেহেতু সন্ন্যাসী পরিচালিত তাই মেয়েরা ব্রাত্য। আর কদ্দিন আমরা এই মধ্যযুগীয় বিশ্বাস নিয়ে চুপ থাকব বলতে পারেন? এও কি অপমানজনক নয়? বলা যেতে পারে অক্সিলিয়াম, ডনবস্কো, সেন্ট জেভিয়ার্সেও তো তাই। কিন্তু আমাদের নরেন্দ্রপুর, রহড়ার মত নামকরা কয়েকটা মেয়েদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কথা বলুন তো সন্ন্যাসী বা সন্ন্যাসীনিদের দ্বারা পরিচালিত? নেই। বাস্তব কথাটা কি বলুন দেখি, অতীতে পুরুষেরা মেয়েদের ব্রাত্য করেছে হেলায়, অবজ্ঞায়। আর মেয়েরা একত্রিত হতে চেয়েছে কিছুটা নিরাপত্তার জন্য, আমাদের তথাকথিত দাপটে পৌরুষের আঁচ থেকে কিছুটা দূরত্ব রাখার জন্য। প্রথমটা দূর করার সময় বহুদিন হল এসে গেছে, দ্বিতীয়টাকে আনতে না পারলে আর সভ্য হলুম কই? 
        সেটাও যুক্তি নয়। আসলে মানুষের দুটো অপযুক্তি হয় - একটা অযুক্তি আরেকটা ধর্ম। প্রথমটা নিয়ে বিদ্রুপাত্মক লেখা লেখা যায়, কিন্তু পরেরটা নিয়ে ধাক্কা দিয়ে ঘুম ভাঙাতে হয়। জাগো বাবু জাগো। মধ্যযুগ পেরিয়ে গেছি আমরা, আমরা অনেকটা এগিয়ে এসেছি, এবার জামা পাল্টাও, নতুন পোশাক পরো, নতুন আলোতে ভাবো।