সৌরভ ভট্টাচার্য
3 July 2019
অভ্যাসের সম্পর্কের দায় বড় বালাই। ছাড়তে গেলে মনে হয়, অ্যাদ্দিনের সম্পর্ক, নষ্ট হবে? আবার রাখতে গেলে বিগত দিনের যত বিশ্বাসঘাতকতা, মিথ্যাচার, চালাকি, অসম্মান ইত্যাদি স্মৃতিতে ভিড় করে এসে বলে, এখনও তাড়াওনি?
না তাড়ানো হয়নি। ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে শান্তি লেগেছে। ঘরে এলে অস্বস্তি লেগেছে – তবু তাড়িয়ে দেওয়া হয়ে ওঠেনি। বলা হয়ে ওঠেনি – আর না। কিন্তু কেন?
এই কেন-র উত্তর না কোনো নীতিমালায় আছে, না কোনো মহাপুরুষের বাণীতে আছে। এ নিতান্তই দুর্বলতা। কিসের দুর্বলতা?
এ ভালো প্রশ্ন। দুর্বলতা আবার কিসের? যদি বলো ভালোবাসার দুর্বলতা, তবে বলব, ভালোবাসা যদি দুর্বলই হল তবে সেকি আর ভালোবাসা রইল? না তো। যা কিছু তার সত্তা হারায় সেকি আর সে থাকে? থাকে না তো। মৃত শরীরের বোঝাটা থাকে বোঝা হয়ে। তবু সে থাকে। দুর্বল প্রাণের প্রশ্রয় আঁকড়ে থাকে। তখন ক্ষণে ক্ষণে তার অভিমান, তার রাগ, একে অন্যকে দোষারোপ, একে অন্যের নামে সুযোগ পেলেই নিন্দা – এগুলো নিতান্তই রোগের লক্ষণ। আসল রোগ হল, মানুষটা আছে, কিন্তু সে সম্পর্কটা আর নেই।
এ অভ্যাসের অভিশাপ। যখন দূরত্বই ভালো, তখন নৈকট্য শুধু অস্বাস্থ্যকরই নয়, বিপদযুক্তও বটে। ক্ষমার অভিনয় তপ্ত, ক্ষুন্ন, ক্ষুব্ধ হৃদয়ে ভাড়া না দেওয়া ভাড়াটের মত। গেলে ঘর ফাঁকা, থাকলে ঘরে উৎপাত। এ জ্বালার মধ্যে এসে জোটে কিছু মায়ের ঘরের মাসি আর বাবার ঘরের পিসী। তারা এদিকেও যেমন ওদিকেও তেমন। এমন পরাশ্রয়ী মানুষরা মিথ্যাচারণ আর মিথ্যাকথাকে রীতিমত একটা শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে চলে যায়। তার চাইতে মজার কথা, সে মিথ্যা ধরা পড়ে গেলে ন্যূনতম লজ্জার কোনো আভাসও চোখেমুখে ফুটে ওঠে না, খানিক বিব্রত হয়, এই আরকি। ভাবটা এমন, “তুমি তো জানোই আমি এমন চরিত্রের সেই নিয়ে আবার জলঘোলা করার কি আছে।“ সত্যিই আশ্চয্যি হতে হয় মানুষের রকমসকম দেখে। তবে এদের নিয়ে কথা বাড়ানো বৃথা, এরা বাঁচে শুধু আবর্জনায়। যদিও বাইরে কাপড়চোপড়ে একদম ধোপদুরস্ত, “ইয়ে পরী চ্যাহেরা, লোগ ক্যায়সে ক্যায়সে হ্যায়”...গালিব।
এসবের মূল ওই একটাই – দুর্বলতা। মৃত শরীরকে নিয়ে বেড়ানো। মৃত আস্থা, মৃত ভালোবাসা, মৃত বিশ্বাস, মৃত অপেক্ষা, তবু যেন সৎকার করে হয়ে ওঠা হচ্ছে না। এ যেন সেই মৃত শরীর আগলিয়ে রেখে বাঁচার মতই বিকৃত আসক্তি। মনের মধ্যে তিক্ততা বেড়েই চলেছে অথচ বাইরে ভদ্রতা, সামাজিকতা, লৌকিকতার মুখোশ আর টান মেরে খুলে ফেলা যাচ্ছে না। এর পরিণতি ভালো নয়। নিজের চোখে দেখেছি মানুষ কেমন ভাবে এই চাপের মধ্যে বাঁচতে বাঁচতে মানসিক ভারসাম্য হারায়। দুশ্চরিত্র, মিথ্যুক, কপট মানুষের সাথে বসবাসের মত অভিশাপ নেই জেনেও, বেরিয়ে আসার সাহসটুকু সঞ্চয় যেন কিছুতেই করা যায় না। ভয় চেপে বসে। অনিশ্চয়তার আশঙ্কা চলবার শক্তিকে বিবশ করে দেয়। প্রতিটা দিন নিজের মৃত্যুর প্রতীক্ষা করবে সে, তবু দরজা খুলবে না। আরো খুলতে দেবে না ওই পরাশ্রয়ী মেরুদণ্ডহীন মানুষগুলো। কিন্তু যে মানুষটা একমাত্র দৈব আর মৃত্যুর দিকে তাকিয়ে জীবন কাটাচ্ছে, সে যদি একবার জানত ওর চাইতে ঢের সোজা দরজাটা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসা, অনিশ্চয়তা বিশ্বাসঘাতক হয় না, বিশ্বাসঘাতক হয় বিশ্বস্ততা, শুধু এই কথাটা বুঝলেই হল।
এ সব মানুষেরা আশেপাশেই। সংসারে আমার নিন্দুকের অভাব নেই। আজ যদি আমি সক্রেটিসের যুগে জন্মাতাম হয়ত বা বিষ খাইয়ে প্রাণে মারা হত আমায় যুবকবৃন্দের মাথায় ভুল চিন্তা ঢোকানোর দায়ে। সাজানো আরামদায়ক মিথ্যায় কোনোদিন সুখ পাইনি, আজও পাই না। তাকে বরাবর অস্বীকার করেছি। অতি নিকটের বন্ধু বা বন্ধুদের বিশ্বাসঘাতকতাতেও হার স্বীকার করে আপোষ করে বাঁচিনি। আজও বাঁচব না। আমার কথাটা আমি বলেই যাব। যে সত্যকে বিশ্বাস করেছি, মঙ্গলজনক জেনেছি তাকে বলেই যাব। ঝড় উঠুক, বন্যা আসুক, ফাঁসি দিক – যাই হোক। কারণ জানি এগুলোর পরেও মানুষ বাঁচে, কিন্তু একবার মিথ্যার সাথে গলা মেলালে আর কোনোদিন আলো দেখা যায় না। সে যেন আলোর মধ্যে থেকেই অন্ধকারে বাস করতে চাওয়া, তাকেই আমি সব চাইতে ন্যাক্কারজনক জীবন্মৃত বলি। তাই আমার সাথে বন্ধুত্ব বড় সোজা রাস্তায় হাঁটা নয় গো, হুম। সাবধান!