Skip to main content

বিশ্বকর্মা পুজো মানে দারুণ উত্তেজনা। উঁহু, এই আজকের কথা না, সে বহুযুগ আগেকার কথা, যখন আমার উচ্চতা কম ছিল, দাড়িগোঁফ হয়নি, কেশ কৃষ্ণবর্ণ ছিল, চোখে চালসে পড়েনি, এবং সর্বোপরি সংসারে নানা বস্তুর উপর কুতুহল ছিল বেজায়।

    তখন হাফপ্যান্ট পরে, সেজেগুজে, বাবার সঙ্গে আমি আর ভাই বেরিয়ে পড়তুম কাঁচরাপাড়া রেল কারখানায়। কোয়াটার্স থেকে কতটা আর দূর? বেশি নয়। রোজ ভোর সকাল দুপুর সন্ধ্যে কারখানা থেকে ভোঁ পড়ে। বাড়ির শার্সি অবধি ঝনঝন করে ওঠে। সিনেমায় দেখেছি বোমারু বিমান আসার আগে অমন ভোঁ পড়ত নাকি। এখানে ভোঁ পড়লে বোম পড়ত না, তাড়াহুড়ো লাগত, নয় যাওয়ার, নয় ফেরার।

    কারখানার সামনে মেলা। পুতুল, খেলনা উজাড় করে বসে আছে সব। কিন্তু এখন না, আগে ঘুরে নিই, তবে তো। পিলপিল করে মানুষ ঢুকছে। দু'রকম মানুষ। এক, আমরা বাঙালিরা। যারা শিক্ষিত, যারা ভদ্র, যারা উচ্চবর্ণ, যারা ভীষণ মার্জিত, যারা রুচিশীল, এবং যাদের জন্যেই নাকি ভারতের যাবতীয় মান আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে আছে। আর ওরা, হিন্দীভাষী, যারা ক্যাটকেটে রঙের শাড়ি পরে, যারা যেখানে সেখানে থুতু ফেলে, যাদের ভাষায় কেউ নোবেল পায়নি, যাদের ভাষায় কেউ অস্কার পায়নি, যারা এমনি আছে বলেই আছে, যাদের ভাষার, অস্তিত্বের কোনো আভিজাত্য নেই, যাদের গানে রবীন্দ্রনাথ, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত এরা নেই, যাদের গান ভীষণ প্রাকৃত, সুক্ষ্মভাব নেই, যাদের সিনেমা শুধুই মনোরঞ্জনের জন্য, বুদ্ধির কিছু নেই, তারা। আমরা ভীমরুল। তারা পিঁপড়ে। যাক গে, এ ফিরিস্তির শেষ হবে না। বিশ্বশুদ্ধ বাংলা মাধ্যমের স্কুল ডকে তুলে, এমনকি স্কুল থেকে রাজার দরবারে সব ফর্ম ইংরাজিতে ফিল আপ করে, চিঠির ঠিকানা ইংরাজিতে লিখে, নিজের নাম সোশ্যাল মিডিয়ায় ইংরাজি অক্ষরে লিখেও আমরা বাংলা ভাষা গব্ব করা কি ছাড়তে পারি? পারি না তো। আমরা বুক চাপড়ে বলি এ সব ভুল যুক্তি।

    উফ্, সে সব কথা কেন? তবে এই বিভেদটা ভীষণ প্রকার ছিল। এটা রেসিজম না, এটা বর্ণবিদ্বেষ না, এটা ভাষা ও সংস্কৃতি বিদ্বেষ। এ আছে। তবে আজকের দিনে অনেকটা কমেছে। কারণ ওরা বেড়েছে, আমরা কমেছি। শুধু কি আর আমাদের হ্যান ছিল, ত্যান ছিল বলে দিন কাটে দাদা! এই যেমন রোজ রোজ শুনি হিন্দী আমাদের ন্যাশেনাল ল্যাঙ্গুয়েজ নয়। অবশ্যই নয়। ভারতে সব ভাষাই রাষ্ট্রীয় ভাষা। এ যেমন সত্যি, তেমন হিন্দীই আমাদের আন-অফিসিয়ালি রাষ্ট্রভাষা হয়ে আছে এও সত্যি। আপামর বাঙালি যখন ভারত ভ্রমণে বেরোয় তখন সে রাস্তাঘাটে, হোটেলে, বাসেট্রেনে, দোকানে, পথচারী ইত্যাদি অতিসাধারণ মানুষদের সঙ্গে কি ভাষায় কথা বলে? বিহারী? ছত্তিশগড়ি? গুজরাটি? মারাঠি? অসমীয়া? মৈথেলি? কাশ্মীরি? অবধি? ব্রজ? বাঘেলি? কনৌজি? ভোজপুরি? যদিও আমাদের কাছে সবই হিন্দী।

    আসলে হিন্দী আমাদের ন্যাশেনাল ল্যাঙ্গুয়েজ না হোক, কিন্তু হিন্দী অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের যোগসূত্রের ভাষা হয়ে আছে এ বিলক্ষণ। ভাষার চূড়ান্ত মর্যাদা সেখানেই। সে অবশেষে যোগসূত্র স্থাপন ছাড়া আর কি করে? সেটুকু সে করে ফেলেইছে।

    এ সব কথা এইজন্যেই বলে ফেললুম ছোটোবেলায় এই উন্নাসিকতাটা আমায় ভীষণ পীড়া দিত। কারা কি করে আমার জানার দরকার নেই, কিন্তু নিজের মধ্যে এত এত বিষাক্ত আলোচনা অসহ্য লাগত। বিরক্ত লাগত। মনে হত, এত অহংকার এদের কিসের? আজও উত্তর পাইনি। তবে এও সত্যি আমাদের কলকাতাকে আমরা ধীরে ধীরে হিন্দীভাষীর কাছে হারিয়ে ফেলছি। তার একটা কারণ আমার মনে হয় আমরা যত নিষ্ঠার সঙ্গে বিদ্বেষ করেছি, ততটা যত্ন নিয়ে নিজেদের গড়িনি। শর্টকাট খুঁজে, আর অতীতের গর্বে দিন কাটিয়ে ভেবেছিলাম সবাই আমাদের প্রধান আসনে বসাটা পাকাপাকি করে রাখবে। তা তো হল না যখন এখন অভিমানে হাত-পা ছুঁড়ে কি লাভ ভাই? নিজেকে সম্মান করলে লোকে সম্মান করতে শেখে। আমরা কি আদৌ সে সম্মানটা নিজের ভাষাকে করেছি? একটা তুচ্ছ উদাহরণ দিয়ে এই প্রসঙ্গটা শেষ করি, প্রতি বছর শিক্ষক দিবসে একটা পোস্ট ঘটা করে বাঙালীকূলকে দিতে দেখি, শিক্ষক রাধাকৃষ্ণাণ, ছাত্র যদুনাথ সিংহের থিসিস কপি করে ভীষণ একটা হেয় কাজ করেছেন। আমি সে বিতর্কে গেলাম না। কেন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী মধ্যস্থতায় সেটা রদ হল, কেন দু'জনেই মামলা তুলে নিলেন, সে অন্য ইতিহাস। কিন্তু বাপু হে, সেই যদুনাথ সিংহের ভারতীয় দর্শন, দিল্লির মোতিলাল প্রকাশনা হিন্দী আর ইংরেজি দুই ভাষাতেই ছেপেছে বহুকাল হল। যদুনাথের লেখা ভারতীয় দর্শনে মনোবিজ্ঞানের ভূমিকা, যা নিয়ে বলা চলে তাঁরই প্রথম কাজ। যে কাজ প্রসিদ্ধ পাশ্চাত্যের প্রকাশক রুথলেজ, যাদের হাতেই রাসেলের সব কাজের সত্ত্ব, তারা ছেপে বার করেছে। সে সব নিয়ে আলোচনা শুনি না কেন? নাকি আমাদের ওই চাটনি মার্কা খবরেই আসক্তি? বাপু হে, যদুনাথের বইটা পড়ে, সে মানুষটা যে সব অসামান্য কাজ করে গেছেন সে সব নিয়ে আলোচনা না করে শুধু রাধাকৃষ্ণান দুষ্টু লোক ছিল ফি বছর চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে বললে শুধুমাত্র নিজের কলহপ্রিয় ও ছিদ্রান্বেষী ক্ষুদ্র সত্তাটারই কেবল সুখ হয়। এত বড় জগতে তোমার ও কেচ্ছা শোনার জন্য কেউ মুখিয়ে নেই। বরং আসল কাজটা করলে মান বাড়ত। কিন্তু ওই যে বললুম, আমাদের গড়ার শব্দের চাইতে, ভাঙার আওয়াজে সুখ বেশি। পরের নিন্দাতে যে সুখ, আত্মসমালোচনায় সে সুখ কই?

    যা হোক, পূর্ব প্রসঙ্গে আসি, তো কারখানায় গিয়ে ইস্তক বড় বড় খোলামেলা ট্রেন দেখে মজে যেতুম। এত এত বড় বড় চাকা খুলে খুলে রাখা। বড় বড় বগি সারানো হচ্ছে, মেরামত হচ্ছে। ট্রেনগুলো দেখলে মনে হত ট্রেনেদের শোয়ার ঘরে ঢুকে পড়েছি যেন। সাজসজ্জাহীন দাঁড়িয়ে আছে সবাই। যেন লজ্জাই পেয়েছে এত এত লোক দেখে একসঙ্গে। আমাদের সবাইকে যেন ট্রেন চেনে। চিনবে না? কোলেপিঠে করে নিয়ে বেড়াচ্ছে না রাতদিন?

    তারপর কারাখানায় কত কত যে ঠাকুর সে গোনা যায় না। যতগুলো শপ, ততগুলো ঠাকুর। আমার আবার বিশ্বকর্মা, শনিঠাকুর আর কার্তিক ঠাকুর গুলিয়ে যেত। যাবে না? এনাদের সবারই গোঁফ আছে না? রাম বা কৃষ্ণের গোঁফ নাই। কেন? তাঁরা হলেন গিয়ে অবতার। দেবতা তো নন। অবতার মানে স্বয়ং ভগবান। ভগবানে গোঁফ নেই কেন? জানি না। শাস্ত্র ঘেঁটে পরে বলব।

    একটা গপ্পো মনে পড়ে গেল। মুরারি বাপু আছেন না? আরে প্রসিদ্ধ রামচরিতমানস এর কথক ঠাকুর গো! উনি একবার একটা বেশ মজার গল্প বললেন। একবার একজন একটা মাটির ঠাকুর গড়ার অর্ডার দেবে। তো সে এসে কারিগরকে বলেছে মঙ্গলমূর্তি গড়ে দিতে একটা।

    কারিগর একটা হনুমানজীর মূর্তি বানিয়েছে বেশ যত্ন করে। এদিকে যে অর্ডার দিয়েছে সে তো ঠাকুর নিতে এসে একেবারে ক্ষেপে আগুন। সে এসে বলল, আরে মশায় আপনি এ কি কাজ করেছেন? আপনি কি কালা? আমি যে মঙ্গলমূর্তি বানাতে বললাম?

    কারিগর ক্ষেপে বলল, আমিও তো তাই বানালুম, দেখছেন না, আপনি কি কানা?

    বায়নাকারী বলল, আরে মশায় গণেশ... গণেশজী'র কথা বলেছি…. তিনি কি মঙ্গলমূর্তি নন?

    তখন কারিগর শান্ত কন্ঠে বলল, ও আমি ভুল বুঝেছি, দাঁড়ান এক্ষুণি সমাধান করে দিচ্ছি। এই বলে সে হনুমানজী'র লেজটা খুলে মুখের উপর বসিয়ে দিয়ে বলল, ব্যস, হয়ে গেল। মুখটা নিজের কেরামতিতে বদলিয়ে পুরো গণেশজী হয়ে গেল।

    এই গল্পের জন্য কেউ অবশ্য মুরারি বাপুকে বকাঝকা করেননি। সাধারণত তা করাও হয় না, তবে তো মধুসূদন, সুকুমার, মায় রবীন্দ্রনাথ তো অবধি দেশছাড়া হতেন।

    যাই হোক, কারখানা ঘুরেটুরে বাইরে এলাম। এইবার তো আসল উত্তেজনা। কতরকম খেলনারে বাবা! আমি হামলে পড়ে খেলনায় ঝুঁকতাম। সঙ্গে আরো কত কত বাচ্চাকাচ্চা। বাবা বলতেন, তাড়াতাড়ি। আমিও মনকে বলতাম, তাড়াতাড়ি। তারপর ঘন্টাবাজা গাড়ি, কি প্লাস্টিকের লাইনে চলা ট্রেন, কি সুতো টেনে ছেড়ে দেওয়া হুস্ করে চলে যাওয়া গাড়ি ইত্যাদি ইত্যাদি। সেই সব কিনে সোল্লাসে বাড়ি ফিরতাম। তারপর পুজোর অপেক্ষা। মানে দুগ্গা পুজো।

    এই হল গল্প। এখন আর রেল কারখানায় যাই না। তবে খেলনার দোকানগুলো খুব মিস করি। বড়দের খেলনা একটাই সংসারে, নিজের ইগো। তার পিছনে সুতো ঘুরিয়ে ছেড়ে দিয়ে বিশ্বজুড়ে হইহই মাতিয়ে রেখেছে। দমও শেষ হয় না, আর নেশাও কাটে না। 'টিন ড্রাম' উপন্যাসে অবাড়ন্ত ছেলেটার হাতে একটা ড্রাম ধরিয়ে দিয়েছিলেন গুন্টার গ্রাস দাদা। সে ছেলের গলার চীৎকারে সব শার্সি ফেটে চৌচির হয়ে যেত। অমন একটা গলাফাটানো চীৎকার করলে হয় না, সব দেমাকি মানুষগুলোর পিলে চমকে? বেশ মজা হয়। সবাই আবার বাচ্চা হয়ে ঝুঁকে পড়ে ঘন্টা বাজানো খেলনা কিনবে। মাটির দিকে তাকাবে। আর বুঝতে পারবে দাঁড়াতে গেলে শুধু পা লাগে না, মাটিও লাগে।