যখন জেগে থাকি, তখন কয়েক ভাগে ভেঙে জেগে থাকি। বাইরের জীবন, পারিবারিক জীবন, ব্যক্তিগত জীবন। মাল্টিপল প্লাগের মত, একই চেতনা থেকে এতগুলো দিকে স্রোত বইছে। চেতনার স্রোত।
কিন্তু এইসব ছেড়েও আরেক ধারা আছে। কারোর কারোর জীবনে প্রকট, কারো জীবনে প্রচ্ছন্ন। যার জীবনে প্রকট, তারও আবার তারতম্য আছে। কারোর অতি প্রকট, কারো মৃদু। সেই ধারার কি নাম দেওয়া যায় ভাবছি। হয় তো এইভাবে বলা যেতে পারে, সে এক অন্তর্লীন জীবন।
এই অন্তর্লীন জীবন কি তবে সাব-কনশাস বা মগ্নচৈতন্য ধারার কিছু? ঠিক তা নয়। এ এমন এক জীবন, যার সঙ্গে বাদবাকি কোনো জীবনের তালমিল নেই। তার বাহ্যিক জীবন, পারিবারিক জীবন, এমনকি ব্যক্তিগত জীবনের চাইতেও এ আলাদা। ব্যক্তিগত জীবন তাও নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, কিন্তু এই অন্তর্লীন জীবন আমার নিয়ন্ত্রণের অতীত। তার অস্তিত্ব অনুভব করা যায়, কিন্তু তাকে অন্য কোনো জীবনে না তো ব্যাখ্যায় ধরা যায়, না তো প্রকাশে। সে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। আমার হাঁ-তে হাঁ, বা না-তে না মেলানোর তার কোনো দায় নেই। সে কেবল নিজের ছন্দে নিজে জেগে থাকে। হয় তো ঘুমের মধ্যেও জেগে থাকে। সব ব্যথা, বেদনাকে নিয়ে নিজের মধ্যে ছবি আঁকে, সুর গড়ে। কিন্তু সেকি এতটাই কাব্যময়? সেকি কখনও বিষাক্ত করে তোলে না সব কিছু কে?
হ্যাঁ, সেও সে পারে। একজন মানুষের বাহ্যিক জীবন, পারিবারিক জীবন, ব্যক্তিগত জীবন…. সব সচ্ছল চলছে। কিন্তু তার অন্তর্লীন জীবনে যদি ছন্দপতন ঘটে, সে ছন্দপতন বাঘা বাঘা ভূমিকম্পের মত সব কিছু তছনছ করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।
এতটা লিখে আমার মনে হল, হয় তো ব্যক্তিগত জীবন আর এই অন্তর্লীন জীবনের মধ্যে পার্থক্যটাকে আরেকটু বলা দরকার।
আসলে আমার অভিজ্ঞতা বলে, এ পার্থক্যকে অনুধাবন করা ভীষণ শক্ত। অধ্যাত্মিক ভাষায়, কবিতার ভাষায় হয় তো বা কিছু ইঙ্গিত দেওয়া যায়, কিন্তু আমি তা চাইছি না। আমি যতটা সম্ভব বাস্তবিক যা অনুভব করেছি তাকেই লিখতে চাইছি।
ব্যক্তিগত জীবনে একটা ব্যক্তিগত আমি থাকে। তার সুখ-দুঃখ, অভাব-অভিযোগ, স্বপ্ন-আশা-আকাঙ্খা ইত্যাদির কথা থাকে। চিন্তাভাবনা থাকে। সেখানে নিজেকে কখনও সক্রিয়, কখনও নিষ্ক্রিয় করে রাখা যায়। কখনও অভিমানে বুক ভরে ওঠে, কখনও দুশ্চিন্তার কালোমেঘ ঘনিয়ে থাকে, কখনও আসন্ন সুখের ভাবনায় চিত্ত মশগুল থাকে। এরকম অনেক কিছু যা শুধু আমিই জানি।
কিন্তু অন্তর্লীন জীবন এর বাইরে। সে যেন সব সময় ধ্যানমগ্ন। বাইরের কোনো কিছুর সঙ্গে তার প্রত্যক্ষ কোনো যোগাযোগ নেই। সে সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন, এমন নয়, আবার যেন বিচ্ছিন্নও। সবটাই তার যেন বাইরে। এমনকি আমার ব্যক্তিগত আমিও। সেও ত্যাজ্য। বড্ডবেশি ত্যাজ্য সে। সেই অন্তর্লীন চেতনার দিকে ফিরলে ব্যক্তিগত আমি শিশিরের মত মিলিয়ে যায়, অথবা জড়ের মত নিষ্ক্রিয় হয়।
ব্যক্তিগত আমি যেমন বাইরের সুখ-দুঃখের ঘটনায় সাড়া দেয়। নিজেকে রিলেট করতে চেষ্টা করে। কখনও পারে, কখনও পারে না। আর যা পারে না তার প্রতি উদাসীন হয়, এই অন্তর্লীন যে জীবন, সে তেমন নয়। তার সংবেদনার পথ যে কি তা বোঝা যায় না। সে কোনো কিছুর ব্যাখ্যা চায় না। দেয় না। সে কি যেন গড়তে চায় একটা। সেই গড়ার সাধনায় তার কোনো কিছুই ফেলনা নয়, আবার কোনো কিছুই আবশ্যিকও নয়। সে দাবী জানায় না, ডাক পাঠায়। সে অভিযোগ জানায় না, অপেক্ষা করে। সে বিষণ্ণ হয় না, পর্বতের মত গম্ভীর হয়ে থাকে। সে উচ্ছ্বসিত হয় না, শরতের পূর্ণিমার আকাশের মত প্রসন্ন হয়ে থাকে।
কিন্তু এ সবের পরেও তার মধ্যে এক বিনষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যখন সে বিনষ্ট হয়, তখন সে বিদ্রোহী আত্মঘাতী অবধি হতে পারে। বাকি সব জীবনকে তছনছ করে দিতে পারে। দেয়ও। বাইরে থেকে কোনো কারণ পাওয়া যায় না। তার কারণ, সাধারণত 'কারণ' যে যুক্তি-বুদ্ধি-অভিজ্ঞতার ধাতুতে জাত, এ সে ধাতুতে জাত নয়। এ এমনই এক গভীর সংবেদন, এমনই এক গভীর বালাই। আমি-হীন অস্তিত্ব, যার কেন্দ্র আছে পরিধি নেই, যার স্বঃপ্রমাণ অস্তিত্ব আছে, কিন্তু গতিপথের কোনো নির্দেশিকা নেই।
(ছবি - গুগুল ইমেজ)