Skip to main content
গত ২৫শে নভেম্বর Al Jazeera নিউজ চ্যানেল বিখ্যাত দার্শনিক, ভাষাবিদ, সমাজবিদ, ঐতিহাসিক নোম চোমস্কি মহাশয়ের একটা সাক্ষাৎকার YouTube এ দেয়। বিষয়ঃ ট্রাম্প জেতার পর ওনার প্রতিক্রিয়া। তীক্ষ্ণ ও ধারালো, তথ্য ও যুক্তিপূর্ণ, মোহ ও পক্ষপাতমুক্ত মন্তব্য একের পর এক ওনার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে করতে করতে শেষ যে কথাটায় এসে দাঁড়ালেন, তার সারমর্ম হল, সমস্যা যত ঘনীভূতই হোক, ভবিষ্যত যতই সংকটময় হয়ে উঠুক না কেন, এ সব থেকে মুক্ত হওয়ার পথ – মানুষের সতর্ক বুদ্ধি। 
 
থমকে গেলাম। কথাটা নতুন না। কিন্তু একেই চরম অস্ত্র বলে চিহ্নিত করার মধ্যে অবশ্যই অভিনবত্ব আছে, বিশেষ করে আজ যখন সব কিছু কৌশলে অথবা যেন-তেন-প্রকারেণ নামক নীতির(?) দিকে ঝোঁক বাড়ছে। গায়ের জোর, মৌলবাদের স্থূল বিধ্বংসী শক্তি স্বগর্বে মাথা তুলে বিচ্ছিন্নতার মধ্যে অস্তিত্ব খুঁজতে চাইছে। মৈত্রী শুধু মাত্র মতলবের তলবদারি করে বেড়াচ্ছে। 
আশ্চর্য হওয়ার আরও আছে। এই একই কথা রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত ‘কালান্তর’ প্রবন্ধ গ্রন্থে সাংঘাতিক জোরের সাথে উচ্চারিত হয়েছে। আমি তার কিছু অংশ তুলে তুলে দিলাম। শুধু এটা বলার জন্য, পথটা চিরটাকাল একই – অবুদ্ধির সাথে লড়াই করা, শুভবুদ্ধির জোরে, সতর্ক বুদ্ধির জোরে।
১) এই উদ্ধৃতিটার প্রাসঙ্গিকতা আজও কোনো অংশে কমেনি। ভবিষ্যতেও যে কবে কমবে সেই আশায় চলা। ইংরাজরা আমাদের শত্রু ছিল না, শত্রু ছিল আমাদের অবুদ্ধি। দেখি ওনার ভাষায় –
“আজকাল আমরা এই একটা বুলি ধরেছি, ঘরে যখন আগুন লেগেছে তখন শিক্ষা-দীক্ষা সব ফেলে রেখে সর্বাগ্রে আগুন নেবাতে কোমর বেঁধে দাঁড়ানো চাই; অতএব সকলকেই চরকায় সুতো কাটতে হবে। আগুন লাগলে আগুন নেবানো চাই এ কথাটা আমার মতো মানুষের কাছেও দুর্বোধ নয়। এর মধ্যে দুরূহ ব্যাপার হচ্ছে কোন্টা আগুন সেইটে স্থির করা, তারপরে স্থির করতে হবে কোন্টা জল। ছাইটাকেই আমরা যদি আগুন বলি তা হলে ত্রিশ কোটি ভাঙাকুলো লাগিয়েও সে আগুন নেবাতে পারব না। নিজের চরকার সুতো, নিজের তাঁতের কাপড় আমরা যে ব্যবহার করতে পারছি নে সেটা আগুন নয়, সেটা ছাইয়ের একটা অংশ অর্থাৎ আগুনের চরম ফল। নিজের তাঁত চালাতে থাকলেও এ আগুন জ্বলতে থাকবে। বিদেশী আমাদের রাজা, এটাও আগুন নয়, এটা ছাই; বিদেশীকে বিদায় করলেও আগুন জ্বলবে-- এমন কি স্বদেশী রাজা হলেও দুঃখদহনের নিবৃত্তি হবে না। এমন নয় যে, হঠাৎ আগুন লেগেছে, হঠাৎ নিবিয়ে ফেলব। হাজার বছরের ঊর্ধ্বকাল যে-আগুন দেশটাকে হাড়ে মাসে জ্বালাচ্ছে, আজ স্বহস্তে সুতো কেটে কাপড় বুনলেই সে আগুন দু দিনে বশ মানবে এ কথা মেনে নিতে পারি নে। আজ দুশো-বছর আগে চরকা চলেছিল, তাঁতও বন্ধ হয় নি, সেই সঙ্গে আগুনও দাউ-দাউ করে জ্বলছিল। সেই আগুনের জ্বালানি-কাঠটা হচ্ছে ধর্মে কর্মে অবুদ্ধির অন্ধতা।“
২) ধর্ম আর কুসংস্কারের মধ্যে পার্থক্য করা, অনেকটা তরকারিতে বরবটি আর লঙ্কা আলাদা করার মত কঠিন ব্যপার হয়ে দাঁড়ায়। যতই সুক্ষ্মভাবে বিচার করি না কেন, ঠিক বরবটি ভেবে লঙ্কা চিবাবোই, আর ঝালের চোটে হাউমাউ করে খানিক পাড়া মাথায় করব। অনেকে অবশ্য লঙ্কার ভয়ে বরবটিও বাদ দিতে চান। আমি আবার বরবটির লোভ ছাড়তে পারি না। তাই সহজ হিসাব করে নিয়েছি- যে জ্ঞান যুক্তি-বুদ্ধি দিয়ে আসে তাকে বলে বিজ্ঞান, আর যে জ্ঞান বুকের মধ্যে প্রেমের মাধ্যমে আসে তাকে বলি ধর্ম। যেমন আমাদের পাড়ার একটা কুকুরের পা কেউ মেরে ভেঙে দিয়েছে, তার যন্ত্রণাটা যে আমায় কষ্ট দিয়ে কিছু একটা করতে বলছে, সে যুক্তি না, সে ধর্ম, আর তাকে সারাতে যে বিদ্যা লাগবে, তাকে বলি বিজ্ঞান। দুই-ই লাগে সুস্থ বাঁচতে। এও রবীন্দ্রনাথের কাছেই শিখতে চেষ্টা। ওর বকুনি তো আজ নতুন খাচ্ছি নে, সেই... যাক উদ্ধৃতিটা দিই –
 
“নিত্য ব্যবহারের জন্যে যে আগুন জ্বালাবার কাজটা তাদের নিজের বুদ্ধির হাতেই থাকা উচিত ছিল কোনো একদিন সেই কাজটা কোনো অগ্নিগিরির আকস্মিক উচ্ছ্বাসের সহায়তায় তারা সাধন ক'রে নিতে পারে। কিন্তু ক্বচিৎ-বিস্ফুরিত অগ্নিগিরির উপরেই যাদের ঘরের আলো জ্বালাবার ভার, নিজেদের বুদ্ধিশক্তির উপর নয়, মুক্তির নিত্যোৎসবে তাদের প্রদীপ জ্বলবে না এ বিষয়ে সন্দেহমাত্র নেই। অতএব যে-শিক্ষার চর্চায় তারা আগুন নিজে জ্বালাতে পারে, নিজে জ্বালানো অসাধ্য নয় এই ভরসা লাভ করতে পারে, সেই শিক্ষা পাওয়াই ঘরের অন্ধকার দূর হওয়ার একমাত্র সদুপায়
আত্মশক্তির পথে চলতে যে-বুদ্ধি যে-অধ্যবসায়ের প্রয়োজন, যে মানুষের তা নেই তাকে অলৌকিক-শক্তি-পথের আভাস দেবামাত্রই সে তার জড়শয্যা থেকে লাফ দিয়ে ওঠে। তা না হলে আমাদের দেশে এত তাগাতাবিজ বিক্রি হবে কেন। যারা রোগ তাপ বিপদ আপদ থেকে রক্ষা পাবার বুদ্ধিসংগত উপায়ের 'পরে মানসিক জড়ত্ব-বশত আস্থা রাখে না, তাগাতাবিজ স্বস্ত্যয়ন তন্ত্রমন্ত্র মানতে তারা প্রভূত ত্যাগ এবং অজস্র সময় ও চেষ্টা ব্যয় করতে কুণ্ঠিত হয় না। এ কথা ভুলে যায় যে, এই তাগাতাবিজ-গ্রস্তদেরই রোগতাপ-বিপদ-আপদের অবসান দেবতা বা অপদেবতা কারো কৃপাতেই ঘটে না, এই তাগাতাবিজ-গ্রস্তদেরই ঘরে অকল্যাণের উৎস শতধারায় চিরদিন উৎসারিত।
যে-দেশে বসন্তরোগের কারণটা লোকে বুদ্ধির দ্বারা জেনেছে এবং সে-কারণটা বুদ্ধির দ্বারা নিবারণ করেছে, সে-দেশে বসন্ত মারীরূপ ত্যাগ ক'রে দৌড় মেরেছে। আর যে-দেশের মানুষ মা-শীতলাকে বসন্তের কারণ ব'লে চোখ বুজে ঠিক ক'রে বসে থাকে সে-দেশে মা-শীতলাও থেকে যান, বসন্তও যাবার নাম করে না। সেখানে মা-শীতলা হচ্ছেন মানসিক পরবশতার একটি প্রতীক, বুদ্ধির স্বরাজচ্যুতির কদর্য লক্ষণ।“
৩) শেষ কথাতে আসি। আমাদের খবরের কাগজগুলোতে বিয়ের বিজ্ঞাপনগুলো দেখেছেন তো? দেখবেন লেখা থাকে ছেলে অমুক অমুক পাশ, অমুক বিদেশি কম্প্যানীতে চাকরি করে, অথবা ডাক্তার, অথবা ইঞ্জিনীয়ার... অমুক গোত্রের, অমুক গণের, অমুক গুষ্ঠিরপিণ্ডীর পাত্রী চাই। কন্যাপক্ষ থেকেও সেই এক কেস। কন্যা যতই শিক্ষিতা হোন না কেন, অমুক গোত্রটি চাইইইই (অবশ্য এ সবের ব্যতিক্রমও আছে)। তা হলে কথাটা হচ্ছে এত বিদ্যা গেল কই? বাড়িতে পুরো বৈদ্যুতিক তারসজ্জা করলাম, অথচ বাড়িতে যেন বিদ্যুৎ সরবরাহের সংযোগই করা হয় নি... অমন বিদ্যার কাঁতায় আগুন। মানুষকে যদি এখনও এমন ভেদে ভাগ করতে পারিস, তো পড়াশোনা সব ৫০০/১০০০ নোটের মত বাতিল করলেই হয়। আর কথা না, শেষ উদ্ধৃতিটি দিই –
 
“নিজের সতর্ক বুদ্ধিকে সর্বদা জাগ্রত রাখতে সচেষ্ট শক্তির প্রয়োজন হয়। যে-সমাজ দৈব গুরু ও অপ্রাকৃত প্রভাবের 'পরে আস্থাবান নয়, যে-সমাজ বুদ্ধিকে বিশ্বাস করতে শিখেছে, সে-সমাজে পরস্পরের উৎসাহে ও সহায়তায় মানুষের মনের শক্তি সহজেই নিরলস থাকে। আমাদের দেশে শিক্ষাপ্রণালীর দোষে একে তো শিক্ষা অগভীর হয়, তার উপরে সেই শিক্ষার ব্যাপ্তি নিরতিশয় সংকীর্ণ। এইজন্যে সর্বজনের সম্মিলিত মনের শক্তি আমাদের মনকে অগ্রসরতার দিকে, আত্মশক্তির দিকে উন্মুখ করে রাখতে পারে না। সে সহজেই অলস হয়ে পড়ে এবং প্রচলিত বিশ্বাস ও চিরাগত প্রথার হাতে গা ঢেলে দিয়ে ছুটি পায়। তার পরে অশিক্ষিতদের সঙ্গে আমাদের প্রভেদ ঘটে এই যে, তারা আপন অন্ধবিশ্বাসে বিনা দ্বিধায় সহজ ঘুম ঘুমোয়, আমরা নিজেকে ভুলিয়ে আফিঙের ঘুম ঘুমোই; আমরা কুতর্ক ক'রে লজ্জা নিবারণ করতে চেষ্টা করি, জড়তা বা ভীরুত্ব-বশত যে-কাজ করি তার একটা সুনিপুণ বা অনিপুণ ব্যাখ্যা বানিয়ে দিয়ে সেটাকে গর্বের বিষয় ক'রে দাঁড় করাতে চাই। কিন্তু ওকালতির জোরে দুর্গতিকে চাপা দেওয়া যায় না। 
দেশকে মুক্তি দিতে গেলে দেশকে শিক্ষা দিতে হবে, এ কথাটা হঠাৎ এত অতিরিক্ত মস্ত ব'লে ঠেকে যে এ'কে আমাদের সমস্যার সমাধান ব'লে মেনে নিতে মন রাজি হয় না।
দেশের মুক্তি কাজটা খুব বড়ো অথচ তার উপায়টা খুব ছোটো হবে, এ কথা প্রত্যাশা করার ভিতরেই একটা গলদ আছে। এই প্রত্যাশার মধ্যেই রয়ে গেছে ফাঁকির 'পরে বিশ্বাস; বাস্তবের 'পরে নয়, নিজের শক্তির 'পরে নয়।”
 
[উপরে উল্লিখিত নোম চোমস্কির সাক্ষাৎকারটির লিঙ্ক নীচে দিলাম]