আমার ভালো থাকা দুই রকমের হতে পারে। আমার আপাতভাবে ভালো থাকা। আর আমার গভীরে, দীর্ঘস্থায়ী ভালো থাকা।
পাশ্চাত্যের স্টোয়িক দর্শন বলেছিল, যা তোমার নিয়ন্ত্রণে নেই, তা নিয়ন্ত্রণ করতে যাওয়ার অতিচেষ্টার মধ্যে তোমার খারাপ থাকার বীজ লুকিয়ে। আরো আগে সে দেশের দর্শন বলেছিল, তোমার ভালো থাকা মানে তোমার মূল্যবোধের ভালো থাকা।
তুমি তোমার ভিতরে প্রবেশ করে দেখো, তোমার মূল্যবোধ ভালো আছে কী? মূল্যবোধ চৌকাঠের মত। তোমার চৌকাঠ ভালো আছে কী?
তোমার মূল্যবোধ ভালো থাকলে তোমার প্রাণে প্রসন্নতা থাকবে। সুখের চেয়ে স্বস্তি থাকবে। কিন্তু যদি মূল্যবোধ ভালো না থাকে তবে যা-ই করো, যত সুখের আগারেই ডুবে থাকো, কোথাও একটা স্বস্তির অভাব অনুভব তো করবেই।
সেদিন একটা বাচ্চাকে নিয়ে তার বাবা মা এসেছিল। সে বাচ্চাটা অনেক কিছু জানে। কিন্তু কোনোটাই তার প্রাণের সম্পদ নয়। সে কবিতা মুখস্থ বলে যাচ্ছে, গান গেয়ে যাচ্ছে, কুইজের মত নানা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছে…আরো কত কী। কিন্তু কোনোটাই তার চোখে মুখে উজ্জ্বল হয়ে দাঁড়াচ্ছে না।
যেন তার বাবা মা তাকে একটা অসীম জ্ঞান আর কলাকৌশলের ভাণ্ডারে ঢুকিয়ে বলেছে, যা বাচ্চা, যা পারিস লুটে নিয়ে আয়। তোর হাতে, কোঁচড়ে, সর্বত্র ভরে নিয়ে আয়। যতটা আনতে পারিস ততটাতেই তুই সফল। তুই অ্যাচিভার।
সত্যি বলতে বাচ্চাটাকে দেখে আমার ভয় লাগল। শুনেছি আমাজনের জঙ্গলে এমন ঘন জায়গা আছে সেখানে নাকি সূর্যের আলো পৌঁছায় না। আমাদের তথ্যরাশির ভাণ্ডার এমন ঘন হয়েছে জায়গায় জায়গায় যে সেখানে প্রজ্ঞার আলো পৌঁছাচ্ছে না। আমরা সেই বাচ্চাটাকে সার্থকতার মানে শেখাচ্ছি না। বলছি না যে তোমার যতটুকুতে আনন্দ, যতটুকুতে সার্থকতার বোধ ততটুকুতেই তুমি সফল। আমরা সফলতার পিছনে সার্থকতা শব্দটা দাসের মত জুড়ে দিতে চাইছি। কিন্তু সার্থকতার অনুগামী যে সফলতা তাকে ভ্রান্ত করছি, ব্যর্থ করছি।
আমার মূল্যবোধ আমার চৌকাঠ। আমার স্বস্তি। আমার শান্তি। আমার আনন্দের উৎস। আমার দুর্দিনের আশ্রয়। আমার সুদিনের নম্রতা। আমার ঈশ্বর আমার মূল্যবোধেরই প্রতিচ্ছবি। যার মূল্যবোধ যেমন তার ঈশ্বরের, আদর্শের প্রতিচ্ছবিও তেমন। যা তার বাকি সব সিদ্ধান্ত, অনুভবকে নিয়ন্ত্রণ করে চলবে আজীবন।
কিন্তু মূল্যবোধ কী? এর কি কোনো সার্বজনীন গঠন আছে?
আছে। নইলে এত এত মানুষের মধ্যে এক যোগসূত্র তৈরি হল কী করে? নইলে এত এত যুদ্ধ-হানাহানি থেকে, বর্বরতা থেকে আমরা সভ্যতার রাস্তায় এতটা রাস্তা এলাম কী করে? তার কোনো একটা মানচিত্র তো আছেই। কিন্তু তার সম্পূর্ণ রূপ আজও বিকশিত নয়। তবে নানা উত্থানপতন দিয়ে আমরা সেইদিকে চলেছি বলেই আমাদের বিশ্বাস। নইলে মহত্বকে চিনি নিজের মধ্যের কোন সত্তার প্রতিচ্ছবিতে? সে ছবি যদি নিজের মধ্যে না-ই থাকত, তবে ইতিহাসের মহান ব্যক্তিদের সামনে নত হতাম কিসের প্রেরণায়? শ্রদ্ধা শব্দটা মানুষের ভাষায় জন্ম নিত কীভাবে?
প্রাচীন গ্রীসে সেদিন সক্রেটিস ঘোষণা করেছিলেন, ভালো থাকার যোগ্যতা আসে মূল্যবোধের অনুশীলনে। মূল্যবোধ জন্মায় আত্মানুসন্ধানের মাধ্যমে। আত্মানুসন্ধানহীন মানুষ শুধু সুখের সন্ধানের রাস্তায় হাঁটলে বাঁচবে কি? আমার সুখের উৎস তো আমারই মধ্যে। তাকে উপেক্ষা করে, তাকে অচর্চিত রেখে, সে ‘মানবজীবন আবাদ’ না করে, শুধু লোভের ভ্রান্ত কম্পাসে ভর করে উন্মাদের মত দৌড়ে বেড়ালেই হবে?
মানুষের ইতিহাস এই মূল্যবোধের লড়াইয়ের ইতিহাস। মানুষের যাবতীয় তর্ক, সমাজ-ধর্ম-রাজনীতি-অর্থনীতি-যুদ্ধনীতি ইত্যাদি সব সব শুধু এই উচিত আর অনুচিতকে নিয়ে। মানুষের যাবতীয় তর্ক যদি শুধু লাভ-ক্ষতি নিয়ে হত তবে কাজটা অনেক সহজ হত। তবে জাস্টিস বলে কোনো শব্দ থাকত না মানুষের অভিধানে। গান্ধারী কোনোদিন বলতেন না অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রকে, সব গেলেও যা থেকে যাবে সে তোমার ধর্ম! ভারতীয় দর্শনে ধর্ম মানে মূল্যবোধ। রিলিজয়ন না।
ব্যক্তি মানুষের, কি রাষ্ট্রের, ভালো থাকার উপায় তার মূল্যবোধের ভালো থাকাতেই। যে মূল্যবোধ আত্মানুসন্ধানজাত। আমাদের পুরাণের গল্পে আছে, একদিন দেব আর অসুরের মন্থনে অমৃত উঠেছিল, সে এই আত্মানুসন্ধানজাত মূল্যবোধ বলেই আমার বিশ্বাস। দেব আর অসুর দুই-ই আমারই মধ্যে। ভারতীয় দর্শনে ধর্ম, তথা মূল্যবোধের আরেক নাম অমৃতও তো। গীতার দ্বাদশ অধ্যায় লক্ষণীয়। বিবেকচূড়ামণি লক্ষণীয়। যেখানে মূল্যবোধকে অমৃতের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। ইদানীংকালে আমরা রামকৃষ্ণদেবের বাণীকেও অমৃত বলছি।
কিন্তু সেদিন মন্থনে অমৃত শুধু ওঠেনি, বিষও উঠেছিল। মহাদেব যাকে কণ্ঠে ধারণ করেছিলেন। মহাদেব মানে ধৈর্য। অশুভকে নাশ না করতে পারি, তাকে ধৈর্যের কারাগারে ধারণ না করে রাখলে সব বিনষ্ট। সে রূঢ়ভাষ হোক, কি নিষ্ঠুর সিদ্ধান্ত।
ঘুমন্ত মানুষের সুখ আর জাগ্রত মানুষের সুখ আলাদা। “কুঁড়ি চায় আঁধার রাতে/ শিশিরের রসে মাতে। ফোটা ফুল চায় না নিশা/ প্রাণে তার আলোর তৃষা/ কাঁদে সে অন্ধকারে”।
আমি যদি জেগে না উঠি আমার আত্মানুসন্ধানে, না খুঁজে পাই আমার মূল্যবোধকে, না স্বস্তি দিই তাকে, আমাকে কি কেউ ভালো রাখতে পারবে?
আত্মানুসন্ধান ছাড়া প্রাচীনকালে কোনো পথ ছিল না। আজও নেই। সেদিনের থেকে আমাদের রাশি রাশি জ্ঞানভাণ্ডার বেড়েছে, আয়ু বেড়েছে, আরামের সামগ্রী বেড়েছে, সুবিধার আয়োজন বেড়েছে। কিন্তু আত্মানুসন্ধানের চেষ্টা দেউলিয়া হয়েছে।
রামকৃষ্ণ ঠাকুর পড়াশোনা না জানা মানুষ। কিন্তু তিনি আঁশচুপড়ির সুখ আর ফুলের গন্ধের সুখের পার্থক্য করেন। উনি বলছেন, তুমি আঁশচুপড়ির সুখে সুখী হতেই পারো। কিন্তু এটুকু শুধু জেনো তার উপরেও আরেক ধরণের সুখ আছে। ফুলের গন্ধের সুখ।
আত্মানুসন্ধানহীন মানুষ অন্ধ। সমাজ অন্ধ। রাষ্ট্র অন্ধ। অন্ধের সুখ গেঁজিয়ে ওঠে। সে সুখের মদের কারবার আজ চারদিকে। সে ফেনিল সুখে আত্মানুসন্ধান নেই। আছে বিধ্বংসী আত্মবিস্মরণ। অবক্ষয়। সাধু সাবধান!