দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার - অতি প্রাচীন কথা। কর্মক্ষেত্রে, শাসককূলে, ধর্মে, সমাজে, জাতিভেদে ইত্যাদিতে এর উদাহরণ ভুরিভুরি। সেগুলোর একটা যথাযথ কারণ আছে। অত্যাচারটা সমর্থনযোগ্য তা বলছি না। কেউ হয়তো শারীরিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ইত্যাদি ভাবে পিছিয়ে আছে। তাই সে নরম মাটিতে বলশালী প্রতাপ ফলিয়ে শুরু করেছে অত্যাচার। তবু সেরকম হলে তার উঠে দাঁড়াবার এবং অত্যাচারের প্রতিবাদ করার সুযোগ আছে ভবিষ্যতে।
তবে সবচাইতে কাপুরুষোচিত অত্যাচার হল, যখন দেখি কেউ বুঝে গেছে, 'এ মানুষটা আমায় ভালোবেসে দুর্বল, এখন যেরকম খুশী ব্যবহার করো না কেন, সে তো আর ছেড়ে যাবে না!'
সেই দুর্বল মানুষটাকে যদি বলি, তুমি যাও কেন মিথ্যা ওর কাছে?
সে অসহায়ের মত চেয়ে থাকে।
যদি বলি, তুমি দুটো কথা শোনাতে পারো না?
সে আমতা আমতা করে উল্টে তারই হয়তো অযৌক্তিক সাফাই গাইবার ব্যর্থ চেষ্টা করে।
যদি বলি, অমন ভালোবাসার দরকার নেই।
কথাটা নিজেরই কানে বাজে। দরকার বুঝে কে আর কবে ভালোবাসল!
তাই এর কোনো যথার্থ প্রতিকারের পথ আমি দেখতে পাই না। এক যতক্ষণ না সে বুঝতে পারে, তার নিজের ভালোবাসার সম্মান রক্ষার্থেই তাকে মানুষটার থেকে দূরত্ব রাখতে হবে। তাতেই উভয়পক্ষের মঙ্গল। তবে এ বোধকে বুঝলেও, বাস্তবায়িত করতে খুব কম মানুষকেই দেখেছি। কিছুটা পরিস্থিতি, কিছুটা তার আত্মবিশ্বাসের অভাব। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঈশ্বর, ভাগ্য ইত্যাদির দোহাই দিয়ে নিজের অসহায়কর অবস্থাকে আরো চোরাবালির দিকে ঠেলে দিয়ে, একটা নিশ্চিত, জড়প্রায় মরণের দিকে নিজেকে নিয়ে যায়।
তবু বলব সেটা কাঙ্খিত পরিণতি না। হতে পারে না। একজন এমন ভালোবাসা বাসল যার পরিণতি স্বরূপ নিজেকেই ভালবাসতে সংশয় জন্মালো - সেটা ভালবাসা না। হতে পারে না। সে মোহ। আর মোহকে ভালবাসলেও সে মোহই থেকে যায়। এটা বুঝতেই হবে। মোহকে মোহ বলেই জানতে হবে। আর প্রেমকে প্রেম বলে চাইতে হবে। প্রেম আমায় ছোটো করে না। আমার মানুষ হয়ে বাঁচার অনুভূতিকে মেরে আমার বুকে প্রেতনৃত্য করে না। সে আমায় বাঁচার গৌরব দেয়, মর্যাদা দেয়। সে মান রাখার দায়িত্ব আমার। পিতলের বাটিকে সোনা ভাবলে, সে দায় পিতলের বাটির না। আমার। এ ভুল যত তাড়াতাড়ি ভাঙে মঙ্গল। তাতে আকাশ ভাঙা দুঃখ থাকুক। পাতালে ডোবা অন্ধকারের চেয়ে। সয়ে নেব। তবু তাই চাই।
ছিন্ন শিকল পায়ে নিয়ে ওরে পাখি,
যা উড়ে যা উড়ে যা রে একাকী॥
বাজবে তোর পায়ে সেই বন্ধ, পাখাতে পাবি আনন্দ,
দিশাহারা মেঘ যে গেল ডাকি॥
নির্মল দুঃখ যে সেই তো মুক্তি নির্মল শূন্যের প্রেমে—
আত্মবিড়ম্বনা দারুণ লজ্জা, নিঃশেষে যাক সে থেমে।
দুরাশায় যে মরাবাঁচায় এত দিন ছিলি তোর খাঁচায়,
ধুলিতলে তারে যাবি রাখি॥
(এ গান গুরুদেবের ছাড়া আর কার হতে পারে! শুনে নেওয়ার অনুরোধ রাখি)
(ছবিঃ সুমন)