ঈশ্বর ঐশ্বর্য বিলাসী। ঈশ্বর যদি ভোট দিতেন অবশ্যই তিনি ক্যাপিটালিস্ট হতেন। কেন?
কদিন আগে তিরুপতি ট্রাস্ট তাদের সম্পদের হিসাব দিয়েছে, ৮৫,৭০৫ কোটি টাকার। এ তো না হয় গেল তিরুপতির কথা। বাকি ভারতের বিখ্যাত দেবস্থানগুলো দেখলেও বোঝা যায় ঈশ্বর, তিনি দেবতা বা দেবী যে রূপেই পূজিত হোন না কেন, ঐশ্বর্যে তাঁর আপত্তি নেই। নইলে অত মূল্যবান অলঙ্কার সারা গায়ে শোভা পেত না নিশ্চয়ই।
আর যদি সে সবও ছেড়ে দেওয়া যায় তবে এই যে বাংলায় মহা উৎসব শুরু হতে চলেছে, সেখানে সপরিবার দেবী দুর্গার আবাহনে সরকার থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্লাব যে পরিমাণ অর্থ ব্যয়ে অতি তৎপর, সেখানেও বোঝা যাচ্ছে ঈশ্বর নিশ্চয়ই ক্যাপিটালিস্ট। নইলে আমাদের মত দেশে, এত দারিদ্র যেখানে, সেখানে তিনি কি করে এত এত ঐশ্বর্য আড়ম্বরের আতিশয্য মেনে নেন?
ঈশ্বর ষড়ৈশ্বর্যবান। তার প্রথমটিই হল ঐশ্বর্য। অনেকের মত ধনসম্পদ, আবার অনেকের মতে অনেক দার্শনিক আলোচনাও আছে। বাকি কি কি? না, বীর্য, যশঃ, শ্রী, জ্ঞান ও বৈরাগ্য। অর্থাৎ বলা হচ্ছে যে তিনি ষড়ৈশ্বর্যবান হলে কি হবে, তিনি বৈরাগ্যবান।
একবার মন্দিরে গয়না চুরি হল। তো ঠাকুর রামকৃষ্ণদেবকে একজন বললেন, কি তোমার ঠাকুর গো, নিজের গয়নাটুকু রক্ষা করতে পারলেন না?
তো ঠাকুর উত্তরে বলেছিলেন, সে তোমার আমার কাছে সোনাদানা, মায়ের কাছে ওসব মাটির ঢেলা বই আর কিছু নয়।
উত্তর তো খাসা। কিন্তু এ উত্তর রামকৃষ্ণদেবকে মানায়, যিনি টাকা আর মাটি সমান করে ফেলেছেন। কিন্তু আমাদের কি আর সে উত্তর মানায়? আমাদের দেবালয়ে ঢোকার আগে হাজার একটা তনুপরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, প্রমাণ করতে যে কোনো অসদ উদ্দেশ্যে আমি ঢুকছি না। এখন যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে, আচ্ছা ঠাকুর, এত সিকিউরিটি কেন দক্ষিণেশ্বরে মন্দিরে ঢুকতে, তোমার ঠাকুর কি ভক্তদের রক্ষা করতে পারেন না? আর তখন উত্তরে ঠাকুর যখন বলবেন, ও বাঁচা মরা তাঁর কাছে সব সমান, তোমার কাছেই কিছু একটা…. তখন? সে উত্তরে কি আমাদের প্রাণপাখি স্বস্তি পাবে, নাকি ডানা ঝাপটে বাবা গো, মাগো বলে উঠবে!
অগত্যা আমাদের অজ্ঞতায় কি আর সে লীলা ধরে পড়ে? আমরা দেখি ঈশ্বর ক্যাপিটালিস্ট। ঈশ্বর ডন। ঈশ্বর ডিক্টেটর। ভক্ত বলে, ডিক্টেটর, কিন্তু দরদী ডিক্টেটর। আমরা বলি হবেও বা! নাস্তিক বুঝে পায় না ঈশ্বর কোনো ক্যাম্পেনিং না করেও এত বড় ভোটব্যাঙ্ক পেয়ে যায় কি করে?
এখন দেখুন, আমরা যতই শাস্ত্র পড়ি, মহাপুরুষদের বাণীটানি মুখস্থ করি, ভাবাবেগে ভাসিটাসি, কিন্তু আমাদের বোধ তো অবশেষে আমাদের বোধই। সেখানে তো আমরা আটকেই।
এখন দেখুন ভণ্ড তো আমরা কমবেশি সবাই। তবে এই ধর্মের বেলায় এসে আমাদের ভণ্ডামিটা ঐতিহ্যমন্ডিত হয়ে ওঠে। কারণ এক, আমার বাপ ঠাকুর্দা আগের যুগ থেকে করে এসেছে। দুই, আমার চারদিকে দল বেঁধে করে যাচ্ছি। তো হল কি, এক যুগান্তরের ধারাবাহিকতা, দুই, গণ যোগদান, আমাদের ভণ্ডামির অনুশীলনটা সহজ করে দেয়।
কারুর বিপদে যখন শাস্ত্রের দোহাই দিচ্ছি, "কপালের ফের", "ঈশ্বরের ইচ্ছা" এইসব বলে নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছি, সেই বিপদ আমার ঘাড়ে এলে আগে কি কি জাগতিক উপায় আছে তার খোঁজে পাগল হয়ে যাচ্ছি।
ব্লাডব্যাঙ্কে গিয়ে রক্তের জন্য লাইনে রিকুইজিশন অনুযায়ী রক্ত পেলেই ধন্য মনে করছি, কিন্তু সমাজে এসে বিয়ে ইত্যাদিতে হাজার একটা গোষ্ঠীতে ভেঙে দল ভাগ বলছি, এ আমাদের আর্যকৃষ্টি।
নানা জায়গায় দীক্ষাটিক্ষা নিয়ে অধ্যাত্মক্লাবে নাম লিখিয়ে ফেলছি। সোশ্যালমিডিয়ায় গুরু, দেবতা ইত্যাদির ছবি আর বাণীর বন্যা বইয়ে দিচ্ছি, এদিকে আত্মপ্রচারে ক্ষণমাত্র বিপন্নতায়, কি স্বার্থে কিঞ্চিৎ আঘাতে জগত মাথায় করে নিচ্ছি!
এদিকে পাড়ায় হাড়ি চড়ে কি চড়ে না কোন বাড়ি, চিকিৎসা কি পড়াশোনার জন্য কোন বাড়ির কি অবস্থা জানা নেই, কিন্তু পুজোর আগে চাঁদার বিল এসে হাজির সে বাড়ির দরজায়। মাইকে তারস্বরে রাত্রদিন গানের শ্রাদ্ধ করে ছাড়ছি, কার কি অসুবিধা, কার স্বাস্থ্যের কি গতি…. ওসব নিজের কাঁথার তলায় রাখুন। আসুন আলো দেখুন, প্যাণ্ডেল দেখুন, ভোগ খান, প্রতিমা দেখুন মোচ্ছব করুন। সমস্যা? সে তো বারোমাস? তার সমাধানের জন্য পরিকল্পিত চেষ্টা? আরে তার জন্য সরকার আছে…আমরা কে? আপনি কে? এখন মাতুন, মেতে যান, "মাতল যে ভুবন".... আসুন আসুন মাতুন। গরীব? বাহ রে, বস্ত্রদান, কম্বলদান…. আছে না? ওতেই হবে… আসুন, মাতুন।
তবে এত এত মহাপুরুষেরা কি শেখাতে এলো? ভদ্র ভাষায় সোনার পাথরবাটি। আর লৌকিক ভাষায়.. থাক।
কিচ্ছু শিখিনি আমরা। আর শিখবই বা কেন? ওসব কথা মেনে চলতে গেলে বারোটা মাস লাগে, জীবনের অর্ধেক সময়ের বেশি চলে যায়। অতটা অপচয় কেন করব? ক'টা বই, কিছু মুখস্থ কথা, ক'টা ছবি, কিছু যাতায়াত…. ব্যস… আবার কি?
জীবনে এক খাঁটি মানুষের সংস্পর্শে এসেছিলাম। পরম বৈষ্ণব। তিনি বলেছিলেন, ধর্ম যা মানুষের চরিত্রে পরিবর্তন আনে। তাকে আরো দরদী, আরো সংযত, আরো সাধারণ জীবনে নিয়ে আসে। সে আর কি আছে বাবা? এখন গলায় কণ্ঠি, চন্দনের ফোঁটাকাটা আর নানা উপাদেয় নিরামিষ খেলেই বৈষ্ণব। তৃণাদপি সুনীচেন…. ওসব মুখের কথা… প্রাণের বিশ্বাস আর কই?
হরিদ্বারে একজন বয়স্ক মানুষকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, এখানে কেউ আছেন এখন যাকে অনুভবী মানুষ বলা যায়? তিনি বলেছিলেন, কেউ নেই বাবা…. সব শুধু টাকা চেনে… আমাদের মত ব্যবসায়ীদের বলে গাড়ি পাঠাও, টাকা দাও… এইসব।
তবু জগত মহানুভবশূন্য নিশ্চয়ই নয়। কিছু মানুষ নিশ্চয়ই আছেন, নিজের মত করে লোকচক্ষুর অগোচরে। চলতে ফিরতে তাদেরও তো চোখে পড়ে!
শেষ করি সদ্য যে মহাপ্রাণ মানুষের জন্মদিন গেল তাঁর মায়ের কথা স্মরণ করে। বিদ্যাসাগর মাকে জিজ্ঞাসা করছেন বড় করে দুর্গাপুজো করতে চান কিনা। মা বলেছিলেন, গ্রামে অনেক ছেলেমেয়ে না খেয়ে স্কুলে যায়, তাদের জন্য যদি একটা অন্নসত্র খুলে দেওয়া যায় তবে সে-ই হবে তাঁর কাছে দুর্গাপুজো।
হায়! এসবই আমাদের কাছে গল্প শুধু। আবেগের গল্প। কাজের না। অনুপ্রেরণার না। আমাদের শিক্ষা থেকে শুরু করে সবই এখন বৈভবের দাসত্ব করে। বিত্ত হতে চিত্ত বড়, এ কথা রবীন্দ্রনাথ আমাদের বোঝাতে চেয়েও পারেননি। কারণ আমরা বুঝতে চাই না। আমরা আমাদের একটা ঐতিহ্য আছে, সোনার পাথরবাটির।