Skip to main content

পরিবার মানেই কি ভালোবাসার ক্ষেত্র? "মায়ের ভায়ের এত স্নেহ কোথায় গেলে পাবে কেহ?"... এ পুরো ঢপের কেত্তন। এত অত্যুক্তি বাপু খুব কম গানেই শোনা যায়। পদে পদে অতিকথন। সে যাক, গীতা মনে আছে? আর ধুর, পুরো গীতাটা কে মুখস্থ বলতে বলেছে, কনটেক্সটটা নিশ্চয়ই জানা আছে। সেটা কি পারিবারিক সুখকর কিছু ভাবভালোবাসার উদাহরণ?

    পরিবার মানেই মিনি যুদ্ধক্ষেত্র। এখানে পদে পদে ইগোর লড়াই। ইগো মানে আমি। আমি মানে আমার মত, আমার পছন্দ, আমার সুবিধা, আমার স্বার্থ। আমার জমি মানে আমার ইগো। আমার জমি আমি সামলাচ্ছি, তোমার জমি তুমি সামলাও। যদি বলো ইগো মানে ছায়া। ছায়া মানে শূন্য। মানে আদতে অমন জমি বলে কিছু হয় না। তারা মুখ ঝামটিয়ে বলবে, ওসব জ্ঞানের কথা। আমাদের মোদ্দা কথাই হল এই জমি। ইগোর জমি। বিনাযুদ্ধে নাহি দিব তিলমাত্র মত। মত মানে আমি। 

    সংসারে জ্ঞান কাজের বস্তু না। সে তার জায়গার থাকুন। শাশুড়ী বউমা ভাগবত শুনতে গেছেন। কিছুক্ষণ পর শাশুড়ী বউমাকে বললেন, বউমা তুমি গিয়ে ভাতটা চাপাও, আমি পুরোটা শুনে আসি। ভালো কথা। বউমা চলে এলেন বাড়ি। শাশুড়ী পুরো ভাগবতকথা শুনেটুনে রাত্তিরে বাড়ি ঢুকতে গিয়ে তো চিত্তির। একি! সারা বাগান মুড়িয়ে গেল কে? বউমা…. ও বউমা….

    বউমা রান্নাঘর থেকে দৌড়ে এসে বললেন, কি মা?

    শাশুড়ী বললেন, একি দেখি বউমা? সারা বাগান মুড়ানো দেখি.. কে করিল এক কাজ! (শাশুড়ীর ভাষায় তখনও ভাগবতের ঘোর)

    বউমা বললেন, কৃষ্ণ…

    অ্যাঁ…. কি বলিস রে মুখপুড়ি... কৃষ্ণ খেয়ে গেল আমার গোটা সাজানো বাগান…!! (শাশুড়ীর ঘোর কাটতে বেশি সময় লাগল না).... তা কোথায় কৃষ্ণ….

    বউমা আঙুল দিয়ে দেখালেন….

    শাশুড়ী দেখলেন তাদের বাড়ির ছাগলটা…. এখনও মুখে শেষ গাঁদাপাতাটা লেগে…. সে মনের সুখে চিবোচ্ছে…

    শাশুড়ী ভাগবত থেকে মহাভারতে নামলেন... ওরে হতচ্ছাড়ি মাগী... এ যে ছাগল…

    বউমা হাতজোড় করে বললেন, কেন মা... কথক ঠাকুর যে বললেন, প্রহ্লাদ বলছেন ভাগবতে, কৃষ্ণ জীবে জীবে অধিষ্ঠিত… আমি বাড়ি ঢুকেই দেখি... আমাদের বাঁধা কৃষ্ণ আমাদের সরেস বাগানের দিকে তাকিয়ে আছে... সেকি করুণ চাহনি মা গো... কৃষ্ণ রাধিকার দিকেও অমন চাহনিতে চেয়েছিলেন কিনা জানি না মা….. আমি আর থাকতে পারলাম না…. দিলাম খুলে….

    শাশুড়ী বাক্যহারা... একবার ছাগলের দিকে তাকান... একবার বউমার দিকে… রাগে মাথায় আগুন জ্বলছে…. বুক জুড়ে প্রেশার কুকারের তাপ... নিজেকে সংযত করলেন... শান্ত দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, দেখো বউমা... এখন থেকে ভাগবতের সমস্ত জ্ঞান এই গেটের বাইরে রেখে সংসারে ঢুকবে, কেমন?

    তো এই হল গল্প। আরেকটা গল্প। আমার নিজের। শীতকালে মা বাথরুমে সরষের তেল রাখতেন। তাকের উপর রাখা। আমার হাত লাগল। সেটা টুক করে মাটিতে আর্তনাদ করে আছড়িয়ে পড়ে কয়েক টুকরো হল। মা এলেন। বুঝলাম আমার কপালে দুঃখ আছে। সত্যম জ্ঞানম অনন্তম ব্রহ্ম। জ্ঞান স্মরণ করলাম। মাকে বললাম, দেখো মা, অজান্তে আমার হাতের সঙ্গে শিশির ধাক্কা লেগেছিল এ সত্য... কিন্তু নীচে পড়ে যাওয়াতে এবং ভাঙাতে আমার কোনো হাত নেই…. ওটা নিতান্তই মাধ্যাকর্ষণের কারণে….

    বাকিটা পাঠককে আর বোঝাতে হবে না আশা করি। মোদ্দা কথা হল সংসারে জ্ঞান বস্তুটি একান্ত বাড়তি। আরশোলার বাইরের বাদামী ডানার মত। সে খালি কাজের সাদা ডানাটাকে ঢেকে রাখার জন্যেই আছে। 

    তো এখন কথা হল এ যুদ্ধে জয়লাভের পথ কি? নেই। সে ভাগ্যের হাতে। কোন্দলের পর কোন্দল হবে। বেশির ভাগই ঠাণ্ডা লড়াই। তবে জেতার কোনো সূত্র নেই। হারজিত দুই মেনে নিতে হবে। 

    ইগো মানে ঘুমন্ত সাপ। শান্ত কুকুরের লেজ। পা না দিয়ে টিপে টিপে চলুন। কথা বলুন। হাসুন। হ্যাঁ তে হ্যাঁ মেলান। না তে না। যতক্ষণ সম্ভব আরকি। যতটা সম্ভব লেজ বাঁচিয়ে চলাই ভালো। কিন্তু তাই কি হয়? শঙ্কা যেথায় করে না কেউ সেইখানে থাকে লেজ পাতা। ধুম করে দিয়ে ফেললেন পা। ব্যস। এবার সামলাও। মহাঝামেলা। কার লেজ যে কোথায় পাতা সে বোঝা বড় দায়। এ ব্রহ্মজ্ঞান হওয়ার মত। কারণ সংসারে স্থূল লেজ এড়িয়ে যদিও বা চলা যায়, সুক্ষ্ম লেজ এড়িয়ে চলা রীতিমতো আর্ট। আর সংসারে সুক্ষ্ম লেজের সংখ্যাই বেশি।

    এই ধরুন, মা যদ্দিন ছিলেন, তদ্দিন প্যাভিলিয়নে বসে দিব্যি সুখে দিন কাটিয়েছি। গপ্পোগাছা করেছি। হাসিমজা করেছি। সংসারময় ব্রহ্ম দেখেছি। হঠাৎ মা ব্যাট নিয়ে প্যাভিলিয়নে এসে বললেন, যাও এবার খেলায় নামো। তিনি হাপিস হলেন। আমি আমাকে নিয়ে উদয় হলুম।

    নাও। আচমকাই মাঠে। কার কি ধরণের বল করার অভ্যাস জানি না। আম্পায়ার নিরপেক্ষ কিনা তাও জানি না। কিন্তু মাঠ ছেড়ে যাওয়ার তো যো নেই। মাঝে মাঝে মেলা লুজ খেলা খেললাম। প্রাণপণে উইকেট রক্ষা করে যাওয়ার চেষ্টা। ক্রমে বুঝলাম কে কোথায় ফিল্ডিং এ আছে। সংসারে সব হাসি হাসি নয়। পাছার কাছে হাত পেতে যে, মায় সেও আমার নয়। এই হল গিয়ে জীবন। সব হাসি হাসি নয়। সব রাগ রাগ নয়। সব মিষ্টি মিষ্টি নয়। সব তেতো তেতো নয়। সব ভালোবাসাও ভালোবাসা নয়। সংসার জুড়ে চায়না মাল... থুড়ি নকল…. আপনাকে আসল বাছতে হবে না, ও আপনিই ধরা দেবে, খালি নকল বাঁচিয়ে চলুন। 

    তবে কি এই শেষ কথা? তা নয়। এ সব সামলিয়ে যদি গভীরে সেঁধিয়ে দেখেন, দেখবেন সবাই আমার আপনার মত একই সমস্যায়। নইলে সংসারে এত এত মহাপুরুষ এলোগেলো, মনে ধরল আমার সারদাদেবীকে এত্ত কেন জানেন? উনি বাপু মেলা কঠিন কঠিন সমাধান দেননি। কিন্তু যা করে দেখিয়ে গেলেন সংসারে সেই হল গিয়ে রাস্তা। তাঁর সংসারে পাগল থেকে শুরু করে হীনবুদ্ধি, স্বার্থপর কি নেই? ও যতই ঠাকুর বলুন না কেন তিনি নাকি অষ্টসখী পরিবৃত হয়ে স্নানেটানে যাচ্ছেন। ওসব ভাবের কথা। আমাদের সিলিণ্ডারের হিসাব, ইলেকট্রিক বিলের হিসাব, বাজারদোকান, এসবের জগতে ওর কোনো মূল্য নাই। আসল কথা হল সবাইকে নিয়ে, কিভাবে চলা লাগে উনি দেখালেন। জীবন বটে মাইরি একটা। মারা যাওয়ার আগে মহাপুরুষেরা কত কত দামী কথা বলে যান। যেগুলো ঘরে সাজানো যায়, কাজে লাগে না। ইনি কিন্তু কি সোজা একটা মন্ত্র দিয়ে গেলেন, "যদি শান্তি চাও তবে কারো দোষ দেখো না, দোষ যদি দেখতেই হয় তবে সে নিজের। সংসারে কেউ তোমার পর নয়, জগতকে আপনার করে নিতে শেখো।"

    আসলে জগতের মালিক বুঝেছিলেন, মেলা পুরুষ পাঠিয়ে পাঠিয়ে খুব একটা লাভ হয়নি, তারা সংসারে আসল ধর্মটা কেউ বোঝাতে পারেনি। তাই এইবার একজনকে পাঠানো যাক যিনি হেঁশেলের ভাষায়, হেঁশেলেই শান্তির কথা বলবেন। তাই উনি এলেন আরকি। মহাপুরুষ না, মহানারীও না। মা। নিজের। আবার সবার।