১) “স্যার বেশি মাস্টারবেট করলে আর বাচ্চা হয় না?"
২) “দিনে ক'বার মাস্টারবেট করা যায়?”
৩) “স্যার আমার মনে হয় আমার একটা টেস্টিস বড়, একটা ছোটো।”
৪) “স্যার কত ফোঁটা রক্ত জমে যেন এক বিন্দু বীর্য তৈরি হয়?”
৫) “স্যার ও কি রোগা হয়ে যাচ্ছে দেখেছেন...? আমার মনে হয় ও দিনে সাত-আটবার...”
৬) “স্যার আমার জ্বর আসছে, গায়ে ফুসকুড়িও আছে, আমার কি এইডস হচ্ছে?”
এরকম প্রশ্নের সংখ্যা লিখলে সে লিস্ট বেড়েই চলবে। দীর্ঘদিন হল বায়োলজি পড়াচ্ছি। সে সিলেবাসে নারী পুরুষের যৌনাঙ্গের বিবরণ, মাসিকচক্র, নানা যৌনরোগের বিবরণ ইত্যাদি আছে। অগত্যা নানা প্রশ্ন, সংশয়, আতঙ্ক মনে জন্মানোটাও অস্বাভাবিক না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যৌনশিক্ষাটা হয়ে যাচ্ছে ‘half baked’, অর্ধপক্ক।
আমি এ আলোচনাটায় যৌনশিক্ষা নিয়ে ঠিক লিখব বলে ভাবিনি। ভাবছি যৌনতা আর ছেলেদের বিষয়ে লেখার। ছেলে মানে বিশেষ করে যারা কিশোর। তাদের নিয়ে আলোচনাটা করব ভাবছি, জানি না কতটা স্বচ্ছভাবে লিখে উঠতে পারব।
মেয়েদের যৌনতার শিক্ষাটা শুরু হয়ে যায় বাড়ির বড়দের থেকেই, যখন তার মাসিকচক্র শুরু হয়। অবশ্যই যৌনতার বোধ আর মাসিকচক্র দুটো আলাদা বস্তু, কিন্তু তবু তারা একে অপরের সঙ্গে যুক্ত। ফলে বাড়ির বড়দের থেকে একটা “স্বাভাবিক” ঘটনার ব্যাখ্যা হিসাবে এটাকে মেয়েরা পেয়ে যায়। যদিও ‘অশুচি’ ইত্যাদি শব্দ জড়িয়ে থাকে, কিন্তু সেটা সামাজিক একটা প্রথা বলে মেনে নেয় বেশিরভাগ মেয়েরাই। যেমন বাঁহাতে শৌচকার্য করতে হয়, যেমন এঁটো কাপড় ছেড়ে ফেলতে হয় ইত্যাদি নানা সামাজিক প্রথার সঙ্গে একেও একটা অঙ্গ হিসাবে অনেকেই মেনে নেয়। সেটা ঠিক না ভুল সে তর্কের জন্য এ লেখা নয়। আমি যে পয়েন্টটা বলতে চাইছি, তারা অন্তত যৌনতা, মাসিকচক্র ইত্যাদিকে স্বাভাবিক ঘটনা বলে জানে।
কিন্তু একটা ছেলের যৌনতাবোধ শুরুই হয় ‘অন্যায়’, ‘পাপ’, ‘অস্বাভাবিক’ ইত্যাদি অনুভব দিয়ে। তার লিঙ্গ উত্থিত হওয়া অন্যায়, তার স্বপ্নদোষ অপরাধের, তার হস্তমৈথুনের ইচ্ছা পাপ ইত্যাদি ইত্যাদি। সেগুলো কেন অপরাধের? কেন পাপ? কেন অন্যায়? কারণ সেগুলো বড়দের সামনে বলতে নেই। এগুলো সব অস্বাভাবিক, এগুলো শুধু বাজে ছেলেদের হয়। এসব ভাবতে নেই। ওই সময় ঠাকুরের নাম করতে হয়। ভালো ভালো কথা ভাবতে হয়। মায়ের মুখ মনে করতে হয়। বাবা শুনলে প্রচণ্ড রেগে যাবে। মা শুনলে ভাববে, ছি ছি, আমার পেটে এই ছেলে জন্মালো? সব ভুলে যাও। কোনো ভদ্রবাড়ির ছেলের এসব হয় না। লুকাও, লুকাও, সব লুকিয়ে ফেলো।
কিন্তু যা আমার ইচ্ছা, আমার সামাজিক নীতিবোধের পরোয়া না করে থেকে থেকেই জেগে উঠছে, তাকে আমি আটকাবো কি করে? এ যে চিত্রাঙ্গদার সেই মোক্ষম লাইন – “কোন্ মহারাক্ষসীরে দিয়েছ বাঁধিয়া অঙ্গসহচরী করি?” এতে যে আমার সুখ! বিষাক্ত সুখ। আমার গোপন বিলাস। আমার লোভ। তীব্র আকর্ষণ এতেই যে আমার। তোমরা যত বারণ করো, তোমরা যত পাপ বলো, তোমরা যত একে অন্যায় বলো, আমার এর উপর কৌতুহল যে আরো বেড়ে যায়। তোমরা এটা বোঝো না কেন, এটা আমি ইচ্ছা করে করি না...।
উপরের প্যারাগ্রাফের কথাগুলো সব স্বগতোক্তি। কে উচ্চারণ করবে? কাকে বলবে? শুধু একটা শব্দেই সব কিছুকে স্বাভাবিক করে দিতে পারত – এটা খুব স্বাভাবিক, সবার হয়। একে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। যা কিছু আমাদের আদিম ইচ্ছা তাকে বুদ্ধি-বিবেকের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করেই সভ্যতা গড়ে উঠেছে। কেউ রাগলেই যেমন কাউকে খুন করে দেয় না, কি পায়খানা পেলেই যেমন যেখানে সেখানে করে দেয় না, এও সেরকম। তবে এর সঙ্গে লজ্জা, অপরাধবোধ, পাপবোধের কোনো সম্পর্ক নেই।
এই কথাগুলো বেশিরভাগ ছেলে তার প্রাক-কিশোর বয়েস, কিশোর বয়েস, বয়ঃসন্ধিতে শোনার সুযোগই পায় না। মনের মধ্যে একটা হীনমন্যতা নিয়ে ধীরে ধীরে পরিণত বয়সের দিকে এগোয়। অনেকের সে হীনমন্যতার বোধ কাটাতে সারাটা জীবন কেটে যায়, তাও কাটে না। অনেকের মধ্যে বিকৃতি জন্মায়। নানা অস্বাস্থ্যকর পরিণতি হয় শুধু একটা কথার অভাবে – সবটা স্বাভাবিক। এ প্রবৃত্তি নিয়েই মানুষ জন্মায়। একে নিয়ে লজ্জার যেমন কিছু নেই, তেমনই একে নিয়ে বাড়াবাড়ি করারও কিছু নেই। এর সঙ্গে শুচিতা-অশুচিতা, ভালোছেলে-মন্দছেলে, পাপী-পূণ্যবান হওয়ারও কোনো সম্পর্ক নেই।
এর পরের প্রশ্ন আসে মানুষের যৌনতার নানা রূপের প্রভেদ নিয়ে। সে অন্য আলোচনা। সে যদি মাইনরিটি গ্রুপের মধ্যে পড়ল তবে তো সমস্যা আরো গভীর। এখানে নারী-পুরুষের সমস্যা প্রায় সমান সমান। কোথাও হয় তো নারীর সমস্যাটা আমাদের মত সমাজে আরো বেশি। কিন্তু সে আলোচনা অন্য।
তবে ছেলেগুলো জানে কি করে, কোনটা ঠিক, কোনটা বেঠিক? সবটাই প্রথমত নিজের ইনস্টিংক্ট, তারপর নিজের বুদ্ধি-বিচারে যতটা কুলায়। বলাই বাহুল্য, মানুষের এতবড় একটা আদিম শক্তিকে আত্মনিয়ন্ত্রণে রেখে সুচারু জীবনযাপনের পাঠ আমাদের সঠিক মাত্রায় আজও দেওয়ার কথা ভাবা হল না। যা হচ্ছে তা ওই যে শুরুতেই বললাম, অর্ধপক্ক। ছেলেরা তাই বন্ধুবান্ধব, ইন্টারনেট, পর্ণ ইত্যাদির দিকে ঝুঁকে সেই অবশ্যম্ভাবী, অপরিহার্য প্রবৃত্তির একটা গতিপথ খোঁজে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নানা ভুল, নানা অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতার মাশুল দিতে হয়। ক্রমে মানসিক অবস্থাটা জটিল হয়। নিজেকে লুকিয়ে রাখাটা একটা অত্যাবশ্যক সামাজিক বিধান হিসাবে মেনে নিয়ে জীবনের জটিল আবর্তে প্রবেশ করে। একটা অর্ধপক্ক শিক্ষা, একটা অর্ধপক্ক ধারণাকে সম্বল করে জীবনে পথ চলা শুরু হয়। এ ভীষণ দুর্ভাগ্যের। আমার শুধু এইটুকুই বলার, আপনারা প্লিজ ছেলেদের সঙ্গে কথা বলুন। শুরুটা না হয় পরোক্ষভাবেই হোক, ক্রমে প্রত্যক্ষভাবে কথা বলার দিন আসবে। কিন্তু প্রজন্মের পর প্রজন্ম শুধু চান্স, আন্দাজ, অস্বচ্ছ ধারণা আর পর্বতপ্রমাণ অপরাধবোধ নিয়ে জীবন শুরু করবে, এ হয় না। একটা কথা মনে রাখতেই হবে, সবার মানসিক গঠন সমান হয় না, সবার মনের জোরও সমান হয় না। এগোতে আমাদেরই হবে নানা অযৌক্তিক, হানিকর সংস্কার থেকে মনকে মুক্ত করে।