'চর্চা' শব্দটার আগে বানান ছিল 'চর্চ্চা'। চর্চ্চ শব্দটার অর্থ আলোচনা, আন্দোলন, উচ্চারণ। সেই থেকে চর্চ্চা, তার থেকে চর্চা। চর্চা মননের শব্দ। মুক্তো কি করে হয়? ঝিনুকের অভ্যন্তরে একটা গ্রন্থি থাকে, ন্যকর গ্রন্থি। সেই গ্রন্থি থেকে কঙ্কিওলিন নামক রাসায়নিক পদার্থ সিঞ্চিত হয়ে মুক্তো তৈরি হয়। কিন্তু সিঞ্চিত হবে কাকে কেন্দ্র করে? বাইরে থেকে একটা ধুলিকণা কি বালুকণা সেই উদ্দীপকের কাজ করে। সেই ধুলিকণা বা বালুকণা নিউক্লিয়াস হিসাবে ধরা হয় স্থূল অর্থে।
আমাদের চর্চা সেই মননের মুক্তো। শুধু একা একা তা হয় কি? হয় না। প্রচুর বই পড়ে তা হয় কি? না তাও হয় না। সেনেকার চিঠিপত্রগুলো তার অসামান্য বিশ্লেষণ। শ্রীরামকৃষ্ণের পুঁথিগত বিদ্যা কতটুকুই বা ছিল, কিন্তু তার চর্চা, তার স্বজ্ঞার তাড়না ছিল এমন গভীর যে মনন-সাগরের তলদেশ মন্থন করে অমূল্য রতনের সন্ধান আমাদের এনে দিয়েছে। সক্রেটিস, খ্রীষ্ট, বুদ্ধ, কনফ্যুসিয়াস, নানক, কবীর এদের প্রত্যেকেরই একই ইতিহাস। প্রত্যেকেই কোনো না কোনো মৌলিক পথে নিজেদের মননের গভীরতা স্পর্শ করেছেন শুধু না, বিশ্বমানবতার সাথে তাকে যুক্ত করেছেন নিরহং প্রচেষ্টায়।
তবে কি পাঠের কোনো মূল্য নেই? আছে। তার মূল্য যতটা না অন্দরমহলে তার চাইতে অধিক বাহ্যিক প্রকাশের অনুশীলনে। সেইজন্যে দেখা যায় অনেক পঠিত একজন মানুষ, অনেক বড় বড় কথা বলছেন, উদ্ধৃতিও দিচ্ছেন, কিন্তু কোথায় যেন একটা মিশছে না। কি মিশছে না? আচরণ, উদ্দেশ্যের সাথে বক্তব্যের। শ্রীরামকৃষ্ণ একে বলতেন এক গোয়াল ঘোড়া। অর্থাৎ কিনা গরু তো নেই-ই সাথে ঘোড়াও নেই। অথবা বলতেন শকুন। অনেক উঁচুতে উড়েও দৃষ্টি ভাগাড়ে। রান্নার পর অনেকে বলেন, তরকারিটা যেন 'হাঁ' করে তাকিয়ে আছে, অর্থাৎ কিনা মিশ খায়নি। এই মিশ খাওয়ার রসায়নটা বড় জটিল, গভীর। তা অক্ষর পাঠে জন্মায় না, তা জন্মায় আত্মপাঠে। ভাবের অঙ্কুরে জন্মায় ভাষা। কিন্তু ভাবই যদি না জন্মায় তবে অঙ্কুর আসবে কোথা থেকে, যা বাইরে থেকে অঙ্কুরের মত দেখায় আসলে তা কলমের কৃত্রিম গাছ। তাতে ফলন হয় বাজারি মতে কিন্তু প্রকৃতির যে ধারাবাহিক অভিব্যক্তির পথ তাতে তার অবদান শূন্য। বিজ্ঞানেও তাই। তাই আজ unlearn কথার প্রবর্তন হচ্ছে। অর্থাৎ মনকে 'জানা'র ভারমুক্ত করো। তবে মননের বেগ স্বাভাবিক হবে। স্বমত স্ব - আলোতে এসে পথ পাবে, পুনরাবৃত্তির হাত থেকে বাঁচা যাবে। পাঠ মনোরঞ্জনের জন্য হলে অবশ্যই আলাদা কথা যদিও।
তবে কোনো পাঠ কি সেই বালুকণার কাজ করতে পারে না? নিশ্চয় পারে। পৃথিবীর যে কোনো ভাষায় পারে। আমরা অক্ষরজ্ঞানী ভারতীয় মাত্রেই বহুভাষী। আমাদের এক ভাষায় না জীবিকা মেটে, না তো হৃদয়। এ প্রথা আজ বলে না, ভারতের নবজাগরণে এ ভাব স্পষ্ট। সেই সময় বিশ্বসাহিত্য নানা মনীষীর কলমে ভারতের মাটিতে প্রবেশের পথ পেল, তাও খাইবার পাসের মাধ্যমে না, রীতিমত রাজপথে। চিত্ত মুক্ত হল নানা'তে, সীমাবদ্ধ অহং-এর আস্ফালনে না। যেখানে যে যুক্তিতেই সীমাবদ্ধতা জন্মেছে সেখানেই মনন বাধা পেয়েছে। সীমাবদ্ধতা শব্দটা ধর্ম আর অন্ধবিশ্বাসের সাথে যায়, চর্চা আর মননের সাথে যদি যেত তবে আজ বিজ্ঞান প্রাদেশিক হয়ে থাকত, মানবতা শতধা। আজ যদি কোনো পদার্থ বিজ্ঞানী কিম্বা জীববিজ্ঞানী বলে বসেন আমি আমার নিজের ভাষা ছাড়া বিজ্ঞান চর্চা করব না, তবে তা নিতান্তই হাস্যকর কথা হয়ে ওঠে। বরং আমাদের বিজ্ঞানের পথেই সার্বজনীনতার চর্চার বেগ বহুগুন বেড়ে উঠেছে। আমরা জানি সালোকসংশ্লেষের তত্ত্ব রাশিয়া, কলম্বো, আমেরিকা, আফ্রিকায় পৃথক হয় না, না তো পৃথক হয় মাধ্যাকর্ষণের সুত্র। যদি কোনো ব্যতিক্রম বা তারতম্য থাকে তারও একটা যুক্তিনির্ভর কারণ দর্শানো যায় বিজ্ঞানে। একেই চর্চা বলে।
চর্চার মূল রসদ বাইরে থাকে না। মূল রসদ থাকে ব্যক্তিত্বে। তাই কোনো মহাপুরুষ পাঠাগারে জন্মায়নি। জন্মিয়েছে মাঠেঘাটে, দারিদ্র্যে, বোধহয় কিঞ্চিৎ অনাদরে, অবহেলায়। বাইরের পাঠ, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যা জীবনপাঠ, তাকে উদ্দীপ্ত করেছে, ক্ষেপিয়ে তুলেছে, সে প্রাণের গভীরে ঢুকে তত্ত্বের আলো খুঁজেছে। কৃত্রিম কোনো পাঠের বিশালতায় সে চাপা পড়েনি, 'বই পড়ে সে বই হয়ে যায়নি', যদি হত তবে সে বড়জোর স্কলার বা পণ্ডিত হত শুধু, মননের আধার যে জ্ঞানী সে হয়ে ওঠা সম্ভব হত কি?
আজ আমাদের সমস্যা হল - এই চর্চার অভাব। আমাদের চর্চা, তথ্য আর উদ্ধৃতির জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে। অতিরিক্ত পদ পাত্রে থাকলে যে তা আমাদের সুষম আহার হয়ে ওঠে না, বরং স্বাস্থ্যের পক্ষে তা হানিকর সে কথা আমরা ভুলতে বসেছি। 'গীতাঞ্জলি'র প্রকাশের সাল, কবিতা বা গানের সংখ্যা, পাতার সংখ্যা, কয় কপি ছাপা হয়েছিল, কোন কালিতে, কোন ফরম্যাটে, কোন প্রেসে, কার তত্ত্বাবধানে ইত্যাদি জানলেই যদি 'গীতাঞ্জলি' জানা যেত তবে আজকের দিনের প্রযুক্তিবিদ্যা, তার চেয়ে সহায়ক কিছুই নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্য এ জানা শুধু আসন পাতা, আসনের উপর উপবিষ্ট হবেন যিনি তাকে আর আমন্ত্রণ জানানোর সময় কারোর নেই। পাখি আর গান গায় না, নড়ে না, শুধু শুকনো পুঁথির পাতাগুলোর আওয়াজ খসখস করে যত আমরা তত উৎফুল্ল হয়ে উঠি - এই তো সফলতা। কিন্তু তা তো সত্য নয়। যে বোধ, প্রজ্ঞা চালকের আসনে আসার কথা ছিল তাকে তো বাইরে থেকে পাওয়া যায়নি? বই তো মানুষ আবিষ্কার করেনি, মানুষ বই আবিষ্কার করেছে। সেই তার সীমাবদ্ধতা জানবে। কিন্তু সে নিজেই যখন 'রক্তকরবী'র অলক্ষ্যে থাকা রাজার মত নিজের সীমানায় নিজেকে আটকে রাখতে চায় তবে তা নিতান্তই লজ্জার, শঙ্কার তো বটেই।
চর্চা ফিরে আসুক। আসবেই। চর্চার প্রধান চালিকা শক্তি তৃষ্ণা। সে তৃষ্ণা পাঠে মেটে না, সে তৃষ্ণা ভাবের গভীরে নীরবতায় মেলে, যখন সে একটা সুত্র আবিষ্কার করে। হতে পারে সে অতি সামান্য, তাই হোক, তবু সে তার মননসঞ্জাত। তাতেই তার পূর্ণাধিকার। তবেই সে নানা পাঠে নিজের সেই অনুভূতির একটা মিল পায়। নিজেকে বিশ্বমানবতার সাথে মিলিয়ে একটা সাজুয্যতায় আসতে পারে। নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে না সে। সে অনুভব করে তার আগেও বহুকাল তারই মতন কেউ এই অভিজ্ঞানের পথে হেঁটেছে, এবং একটা স্মৃতিচিহ্নও রেখে এসেছে অক্ষরের মালায়। কিন্তু সেই মিল পাওয়ার আগে তাকে নিজেকে তো সেই পথে হাঁটার অভ্যাস করতে হবে আত্মশক্তিতে ভর করে, একা। তবে গিয়ে মিলবে সে আনন্দনিকেতন। নইলে অন্যের অনুভূতি আর অক্ষরে দাগ বুলিয়ে আর যা হোক পণ্ডিত হওয়া যায়, প্রজ্ঞার অধিকারী হওয়া যায় না। কারণ মনন ও প্রজ্ঞা পাঠনির্ভর নয়, প্রেম আর জ্ঞানের তৃষ্ণানির্ভর। তার ফল্গুধারার মত বেগকেই বলা হয় চর্চা। যা স্বধর্মীর আশ্রয়ে বাড়ে, তীক্ষ্ণ হয়। কিন্তু স্বধর্মীর অভাবে মারা যায় না। স্বাবলম্বী হয়।