Skip to main content
মরণ রে, তুঁহুঁ মম শ্যাম সমান


মৃত্যু আর প্রেম - সুতোর মত পার্থক্য দুটোর রহস্যময়তায়। ভীষণ আগ্রহ আমাদের - কেমন করে হল? কিভাবে হল? কি করে হয়? কিরকম লাগে সেই সময়টায়? মৃত্যুতে ভয় মিশ্রিত কৌতুহল, উত্তেজনা। আর প্রেমে উত্তেজনা মিশ্রিত উদ্বেগ। 
এই দুটো রহস্যই চিরকাল শান্ত জীবনযাত্রায় কালবৈশাখী এনেছে, ভবিষ্যতেও আনবে। কি অসীম রহস্য! ভুলে থাকবে, সে যো নেই। এড়িয়ে যাবে যে, সে পথ নেই। মুখোমুখি হবে যে, সে সাহস আছে কি? ইতিহাসের কত অধ্যায় ঘুরে দাঁড়াত অন্যখাতে এই দুই বালিঝড়ের অস্তিত্ব না থাকলে জীবনে।

    এরা পরকে আপন করে, আপনারে পর
     বাহিরে বাঁশির রবে ছেড়ে যায় ঘর।।
       ভালোবাসে সুখেদুখে ব্যাথা সহে হাসিমুখে
          মরণেরে করে চিরজীবননির্ভর।।

কে বাজায় এমন বাঁশি কবি? যে মরণের উপর নির্ভর করেই জীবনযাপন করতে হয়? এত দুঃখ চেয়েছিল কেন মানুষ? এমন দাবানলের মত ভালোবাসা কেন কবি? যে সব পুড়িয়ে ছারখার করেও আশা মেটে না তার?

    তবে ক্ষণে ক্ষণে কেন
   আমায় হৃদয় পাগল-হেন
তরী সেই সাগরে ভাসায় যাহার কূল সে নাহি জানে?

   যদি প্রেম দিলে না প্রাণে

কি প্রেম চাইল কবি মানুষ? সংসার বাঁধার জন্য এ প্রেমের আকুতি তো না কবি! এ যে পুড়ে মরার জন্য আকুল তৃষ্ণা। এ প্রেম যে ঈশ্বরকেও রেহাই দিল না কবি

     তুমি রইবে না ওই রথে
       নামবে ধুলাপথে - 
  যুগ-যুগান্ত আমার সাথে চলবে হেঁটে হেঁটে

ঈশ্বর নেমেছেন রাস্তায়। এত অসহ্য যন্ত্রণা না হলে বয়ে চলেছি কিসের জোরে কবি?

তুমি সাধ করে, নাথ, ধরা দিয়ে আমারও রঙ বক্ষে নিয়ো
এই হৃৎকমলের রাঙা রেণু রাঙাবে ওই উত্তরীয়।।

রাস্তা শেষ হতে চায়, শ্বাস ফুরিয়ে আসতে চায়, তৃষ্ণা আর মিটতে চায় না। সন্ন্যাসী বারবার তিরস্কার করেন। নীতিবাগীশ কলঙ্কের ভয় দেখান। মন্দিরের ভগবান মন্দিরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে বলেন, - তুই অশুচি, ফিরে যা! অন্তরের ভগবান দরজা খুলে বলেন, ভিতরে আয়। মৃত্যুকে বরণ কর। মরণ মানে শ্বাসের ফুরিয়ে যাওয়া না। মরণ মানে শ্বাসরহিত হয়েও বাঁচার অভ্যাস। বাউল বুঝল। বলল, জ্যান্তে মরো... মরো... মরো... মরে গিয়ে বাঁচো। 
সব লাজলজ্জা ত্যাগ করে দাঁড়াই এসে জয়দেবের সামনে। বলি, গাও জয়দেব। সংসার আজ বড় আলুনি আমার কাছে। ওরা বাঁশি শোনেনি জয়দেব। ওদের ঘুমাতে দাও। আমার ঘুম যে ছুটেছে জয়দেব। তুমি বলেছো প্রেম কি? প্রেম গরলামৃত। অমৃতে গরল মিশেছে আজ আমার জয়দেব। পৃথিবীর কোনো ধর্ম, কোনো নীতি আজ আমায় শান্তি দেবে না জয়দেব! ওরা ভয়ও দেখাতে পারে না আজ আমায়! তুমি এসো। আলিঙ্গন করো আমায়। সম্পূর্ণ উলঙ্গ না হলে তো তুমি আলিঙ্গন করো না বন্ধু। আজ আমি সম্পূর্ণ উলঙ্গ জয়দেব। 
তুমি গেয়েছো গীতগোবিন্দে যেন অরসিকের সামনে তোমায় গাইতে না হয়। সে সব চাইতে বড় অভিশাপ কবি জীবনে। কবি আমিও চাই না অরসিকের মধ্যে জীবনধারণ আর। আমায় আজ নিয়ে চলো নিভৃতে। সেখানে শুধু তুমি আর আমি থাকি। পাশে বসুক মরণ আর প্রেম, দুই সখীর মত।
সে কি এলো জয়দেব? তার পায়ের নূপুর কি পেলে শুনতে? তার মাথার শিখীপাখায় কি চাঁদের কিরণ লুটিয়ে পড়ে তার সারা মুখ শীতল চুম্বনে ভরিয়ে তুলছে? তার গলার মালার ফুলের থেকে ভ্রমরের গুঞ্জন কি কানে এসে পৌঁছেছে তোমার? কে তুমি আমার সামনে দাঁড়িয়ে? তুমি জয়দেব না রবীন্দ্রনাথ? কি গাইছ তুমি?

  রতিসুখসারে গতমভিসারে মদনমনোহরবেশম্‌ ?!

 না গাইলে?

  মরি লো মরি, আমায় বাঁশিতে ডেকেছে কে?

কে তুমি? রবীন্দ্রনাথ না জয়দেব? যেই হও, এসো, আমায় বন্ধু বলো, হাতদুটো দাও... আহা... চন্দনের গন্ধে ভরে যাচ্ছে আমার মনপ্রাণ বন্ধু... কি অসহ্য যন্ত্রণা সখা!... কি আনন্দ!... এ সংসারকে চুপ করতে বলো দু'দণ্ড... বলো না গো... সে কি এলো... এলো... এলো?

[আজ কেঁদুলিতে চলছে জয়দেবের মেলা]

(ছবি - আন্তরজালতন্ত্র থেকে)