সৌরভ ভট্টাচার্য
24 November 2017
আজ
এক নতুন তথ্য জানলাম, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় নাকি রবীন্দ্রনাথের কাব্যগুণ বুঝতেন
না। সুবিনয় রায় আর গীতা ঘটকের কথাও আছে, তাঁরাও বুঝতেন না। অনাবশ্যক, আনুনাসিক,
সুরের ‘মায়ায়’ নাকি শ্রোতাকূলকে বিভ্রান্ত করে গেলেন। বুঝলেন কে? সুচিত্রা মিত্র,
দেবব্রত ইত্যাদিরা।
কে
বলছেন? একজন রবীন্দ্রসংগীত ‘গবেষক’ তার ফেসবুক পেজে। "আমার কণিকার গান পছন্দ
না" - এত অবধি বুঝতে অসুবিধা হয় না, কিন্তু তার থেকে ভালো গাইতেন অমুক অমুক
শিল্পী, এটা শুনেই থতমত খেলাম। কারণ যে শিল্পীদের নাম করলেন, তারা নিজেরা যদি
শুনতেন এই কথাটা, ভবলীলাসাঙ্গ করতেন হয়ত বা (তাদের নামগুলো আমি ইচ্ছা করেই আর
উল্লেখ করলাম না, কলম সরল না, অন্তত তাদের তো একটা সম্মান আছে নিজের জায়গায়)।
আমি
তকমাধারী গবেষক নই। তবে বুঝি, ‘আজ কিছুতেই যায় না মনের ভার’, কিম্বা ‘আমার যেদিন
ভেসে গেছে’, কিম্বা ‘আকাশভরা’ শুনতে দেবব্রত চালাই; কিন্তু কখনওই দেবব্রত'র গলায়
‘বাজে করুণ সুরে’, ‘আনন্দধারা', ‘বেদনা কি ভাষায় রে’ ইত্যাদি শুনব না, কণিকারই
শুনব। ‘প্রচণ্ড গর্জনে আসিল’ সুচিত্রাই শুনব, সুবিনয় না; কিম্বা ‘এ কি
সুগন্ধহিল্লোল’ সুবিনয়েরই শুনব।
তালিকা
আর দীর্ঘ করলাম না, কিন্তু নাটকীয় উপস্থাপন হলেই তাতে কাব্যের মূল্য রাখা গেল,
বাকিরা রাখলেন না, কারণ তাদের গায়কীতে সুরের গভীর চিন্তন আছে, গায়নে সে নাটকীয়তা
নেই বলে – এ নিতান্তই বালখিল্য কথা। ভীমসেন যোশী আর আমির খাঁ - মেজাজ আলাদা,
কিন্তু দুই-ই অনুভবের প্রকাশের দুই ধারা। বলা হবে রবীন্দ্রনাথের গান তো
কাব্যপ্রধান। ব্যস, হয়ে গেল আর কি, সুর তো গৌণ। ঠিক এই ভয়টাই সত্যজিৎ রায়
করেছিলেন, বলেছিলেন, উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে যথাবিহিত তালিম নিয়ে যেন রবীন্দ্রনাথের গানে
আসা হয়। নাটকটা সহজেই চোখে পড়ে, মনের উপর একটা রেখাপাত করে, কিন্তু সুরের গভীর
আবেদনে ডোবার জন্য শ্রোতারও একটা চর্চা থাকা জরুরী। সুচিত্রা মিত্র এক জায়গায়
বলছেন তথ্যচিত্রে,“গানে মোহর (কণিকা) আমার ধরাছোঁয়ার বাইরে”।
তবে
আলোচনাটা শুধু রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে নয়। আশঙ্কা, এই ধরণের গবেষণার পাত্ররাও ছাড়পত্র
পাচ্ছেন। এবং এদের লেখা গবেষণাপত্র ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে স্বীকৃত তথ্য হিসাবে
পৌঁছাবে। তবে কি আমাদের সাধারণ মেধার মান এমন তলানীতে এসে পৌঁছালো?
ফেসবুক
খুললেই, একটা লিঙ্ক আসছে, কিছু একটা বৌদি নিয়ে গান। অর্থাৎ বৌদিবাজি কালচার। এই
নামাঙ্করণ বেশ পুরোনো। “ভয় যদি পাও আরশোলায়, সব্বাই তার সুযোগ চায়”। সব্বাই? মানে,
আমি আপনি প্রত্যেকেই? হ্যাঁ, গীতিকারের(?) মতে তাই। ক'দিন আগে ফেসবুকে আমার
অত্যন্ত শ্রদ্ধেয়া সুপ্রিয়া মাসি, একটা পোস্ট করেছিলেন, ‘বাঙালী কেন কবি নয়’,
রবীন্দ্রনাথের। সেখানে রবীন্দ্রনাথ বাঙালীর কল্পনার দৈন্য নিয়ে বলছেন। কল্পনা
অবশ্যই আকাশকুসুম না, কল্পনা যা বড় কিছু করতে উদ্বুদ্ধ করে। “I have a dream” বলতে
লুথার যে কল্পনা বলেছিলেন, এ সে কল্পনা।
কল্পনার
দৈন্যর সাথে যদি অসংযমী হয়ে ওঠা সাহসিকতার পরিচায়ক হয়, তবে রোগ আরো গুরুতর হয়ে
ওঠে। শিল্প–সাহিত্যচর্চার একটা প্রধান অঙ্গ ‘সংযম’, মাত্রাজ্ঞান। এ মাত্রাজ্ঞান
একদিনে হয় না। রামকৃষ্ণদেব বলতেন, বৈদ্য'র সাথে থাকতে থাকতে কোনটা কফের নাড়ি,
কোনটা পিত্তের নাড়ি মানুষ চিনতে পারে। এ নিয়ে অল্পজ্ঞরা তর্ক জুড়তে পারে, কিন্তু
বিশ্বের দরবারে তারা মুখচুন করেই ফিরে আসে। সারা বিশ্বে সাহিত্য-শিল্প-চলচ্চিত্র
যে জায়গা ছুঁতে চাইছে, যে প্রয়াস চলছে, আমাদের তা কই? একটু সিনেমার জগতটা দেখা
যাক। আমরা যখন ছোটো ছিলাম (আমার জন্ম ১৯৭৬), তখন ‘হিন্দী সিনেমা’ একটা অচ্ছুৎ
শব্দের মত ছিল। মধ্যবিত্ত বাঙালী নাক সিঁটকাতো, ওমা! হিন্দী সিনেমা দেখে, ম্যাগো!
কি সব অখাদ্য গান, বদরুচি, ছেলেমেয়ে মানুষ হবে?
গত
কয়েক দশক ধরে হিন্দী সিনেমার পরিবর্তন দেখুন। সামাজিক যে সমস্যাগুলো নিয়ে তথাকথিত
‘বুদ্ধিজীবি’ হওয়ার আত্মতুষ্টিতে ভোগা বাঙালী মাথাই ঘামায়নি, তারা সে সে বিষয়ে
সিনেমা করে দেখাচ্ছে। বহু সিনেমার নাম করা যায়, সে থাক। আজই রিলিজ হয়েছে ‘কড়ভি
হাওয়া’। পরিবেশের, আবহাওয়ার পরিবর্তন, বৃষ্টির আকাল ইত্যাদিতে মানুষের জীবনে তার
প্রভাব। এই নিয়ে একটা সিনেমা করার কথা আমরা ভাবতে পারছি কই এখন বাংলায়? হিন্দী
সিনেমার জগতে চিত্রনাট্য, অভিনয়, সঙ্গীত নিয়ে যে পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে বাঙ্গলায় তা
কই?
আমি
লেখক নই। পাঠক তো বটেই। প্রচুর বই পড়তে ভালোবাসি। নানা বিষয়ে। অগত্যা মাতৃভাষায়
কুলায় না, ইংরাজির শরণাপন্ন হয়েই থাকতে হয়। যেটা মজার কথা হল, ফেসবুকের দৌলতে বহু
নামী লেখকদের সাথে সাক্ষাতে কথা হয়েছে, তাদের অনেকের কি অসম্ভব কম পড়াশোনা দেখে মর্মাহত,
বিস্মিত হয়েছি। যদিও ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। কিন্তু খুব কমই সংখ্যায় তাঁরা। জানি না
জয়পুর আজ যে মাত্রার সাহিত্য উৎসবের প্রথা শুরু করে দেখিয়ে দিচ্ছে, আমরা ক্রমশঃ
পিছিয়ে যাচ্ছি কেন? সেও কি এরমকই কিছু কারণে? আজ আমাদের সাহিত্য আন্তর্জাতিক
ক্ষেত্রে কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে একটু মাথাটা উঁচু করে দেখলেই চোখে পড়ে। নিজের দেশ,
ইতিহাস নিয়ে আগ্রহ কি কমছে আমাদের? আন্তর্জাতিক হওয়া মানে কিন্তু বিশ্বের নানা
তথ্য জেনে তার খিচুড়ি করে কিছু একটা লেখা নয়। নিজের দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি,
সমাজের মধ্যে দিয়ে বিশ্বমনের সত্তার কাছাকাছি পৌঁছানোর প্রয়াসকে আন্তর্জাতিকস্তরে
পৌঁছানো বলে। বিভূতিবাবুর ‘হরিহর-সর্বজয়া’, মানিকবাবুর ‘শশী’, তারাশঙ্করের
‘বানোয়ারি’ – কেউ সে অর্থে গ্লোবাল নয়, কিন্তু লেখকের কলমে তারা পৃথিবীর যে কোনো
প্রান্তের মানুষের আত্মীয়তা অর্জন করতে পারে। যেমন পেরেছে টনি মরিসনের 'সেথে-ডেনভার’,
নাইপালের ‘মিস্টার বিশ্বাস’, দস্তয়েভস্কির ‘কারামাজোভেরা’ কিম্বা টলস্টয়ের
‘লেভিন’।
প্রসঙ্গান্তরে
যাই। রম্যরচনা। কই? সেই বিশুদ্ধ, বুদ্ধিদীপ্ত, তীক্ষ্ণ, কখনও কখনও শ্লেষাত্মক
হাসির উপাদান কই এখন? আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়, একজন সাহিত্যিকের লেখার সবচাইতে
ধারালো দিক তার এই ব্যঙ্গাত্মক উপস্থাপনা। মীরাক্কেলে যে সব জোক্সে বাঙালী রাতের
পর রাত হেসেছে, শিউরে উঠেছি। যৌন সুড়সড়ি, অশ্লীলতার দ্ব্যর্থ উপস্থাপন, অত্যন্ত
নিম্নমাত্রার ভাঁড়ামি – এই কি অবশিষ্ট পড়ে রইল হাসির উপাদান হিসাবে?
প্রবন্ধের
প্রসঙ্গ থাক। হীরেন দত্ত, অশোক মিত্র, শিবনারায়াণ রায়, অম্লান দত্ত'র স্বাদ তো আর
পাচ্ছি না। বড্ড অগভীর। বড্ড একপেশে। বড্ড মেরুকৃত বেশিরভাগই এখন। প্রতিবারের
বইমেলার দিকে মুখিয়ে থাকা, 'বইয়ের দেশে' খুঁজে ঝুঁকি নিয়ে কলেজস্ট্রীট চষে বই কেনা
(ঝুঁকি, কারণ অত ট্যাহা কই?), মৃতপ্রায় লাইব্রেরীর চরকি কাটা, ফেসবুকে নতুন
স্বাদের, সৎ লেখা খোঁজা (অনেকেই অসামান্য ভালো লিখছেন, বিশেষ করে জীবনের নানান
ক্ষেত্রের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা), অবশেষে ইংরাজি ভাষায় বিদেশি বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড
করে তৃষ্ণা মেটানো।
তাই
বলছিলাম, আমরা কি মধ্যমেধার রুচির থেকেও নামছি? অবশেষে কি বঙ্গসন্তানদের পৌরুষ
বৌদিবাজি, ‘তবে হয়ে যাক’ই? বিশ্বের দরবার কি আঙুরফল টক?
(সমস্ত মত অবশ্যই ব্যক্তিগত)