Skip to main content
 
      সব আমার হাতে নেই। আমার নিয়ন্ত্রণে নেই। আমার ইচ্ছানুযায়ী ঘটে না। আমার ভালো লাগাটা পাত্তাই দেয় না। এ সব ঠেলা সামলানো আমি শিখছি। প্রতিদিন শিখছি। একটু একটু করে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া অভ্যাস করছি। মানে পাতা হাত গুটিয়ে নেওয়ার কথা বলছি। কিছু পাওয়া যায় না তা বলছি না, যেটুকু পাওয়ার ছিল তার বেশি পাওয়া যায় না। কিন্তু আগে থেকে কি করে বুঝব কতটুকু পাওয়ার ছিল? এতো পাঁচশো মুড়ির প্যাকেট নয় যে দোকান থেকে কিনে বাড়ির কৌটোর বপু দেখে বলে দেব কতটা আঁটবে, আর কতটা আঁটবে না। কেউ সে হিসাব আমার হয়ে করে দেবে তারও তো জো নেই। তেত্রিশ কোটি দেবতাই খাবি খাচ্ছে দাবিদাওয়া পুরোতে, তায় লক্ষকোটি দেশি-বিদেশি জ্যোতিষী, বাস্তুকার, গুরু ইত্যাদি সব ফেল। তাই কতটুকু সত্যিই আমার পাওয়ার ছিল আগে থাকতে বুঝি কি করে? হবে না। বরং কতগুলো মতবাদ আলোচনা করা যাক।
 
প্রস্তাব - ১) দাও, আর ফিরে নাহি চাও
 
 
ভেবে দেখলাম কথাটা। কারোর কাছ থেকে কোনো প্রত্যাশা না রেখে চলার চেষ্টা করলাম। প্রথম প্রথম মনে হল বেশ এগোচ্ছি। খানিক পরে দেখলাম আসলে আমি পারছি না। প্রত্যাশা না রাখার জন্য মনটা বেশ উঁচু গদিতে চড়ে বসতে চাইছে। তার কথা হল, আমি যদি কিছুই চাইব না, তবে নিজের সেই ঘ্যামটাই বা না দেখাই কেন? তাকে ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিই না কেন, দ্যাখ, তোর কাছ থেকে আমি কিচ্ছু চাই না, তবু আমি তোকে ভালোবাসছি, তোর ব্যাপারে মাথা ঘামাচ্ছি, এ নিতান্তই আমার মহানুভবতা। যদিও প্রকাশ্যে তা স্বীকার করায় আমার সামাজিক শিক্ষায় লাগে – অহংকার করতে নেই।
      বুঝলাম কথাটা হজম হয়নি। নিষ্কাম কর্ম করা যায় না সে কথা অবশ্য দক্ষিণেশ্বরের খুড়ো আগেই পঁই পঁই করে বলে থুয়েছে। বলেছে, যতই তুমি ভাবো নিষ্কাম কর্ম করছ, কিন্তু কোথা থেকে অহং-এর ফেকড়ি বেরিয়েই পড়ে। খাঁটি কথা। একদম পার্ফেক্ট অবজারভারের কথা। এই তো হয়। আরে কাগজে কলমে তো কত কিছুই লেখা থাকে, সে সব সত্যি হলে বইয়ের পোকার দাম নিলামে চড়ত। ওদের জেনেটিকে অক্ষরগুলো আত্মসাক্ষর রেখে যেত, পোকারাই রাজত্ব করে বেড়াত। 
অর্থাৎ এ পথ সে পথ নয়।
 
প্রস্তাব – ২) ঝোপ বুঝে কোপ মারো।
 
 
আগেরটার ঠিক উলটো অবস্থান। আগেরটা খানিক অবাস্তব হলেও নীতিগত বা আদর্শগত দিক থেকে বেশ উঁচু ধরণের। কিন্তু এ মতের কথা হল, বুঝেশুনে ইনভেস্ট করো নিজেকে। এক একটা সম্পর্ক এক একটা ইনভেস্টমেন্ট। মানসিক, শারীরিক, নিরাপত্তা, ভালো থাকা, তোষামুদে রাখা, শত্রুকে চমকে দেওয়ার জন্য রাখা, নিজের কথা শোনানোর জন্যে রাখা, বেড়াতে যাওয়ার জন্য রাখা, আদিরসের জন্য রাখা ইত্যাদি ইত্যাদি। মানুষের প্রয়োজনের শেষ নেই যেমন, মানুষকে ব্যবহার করার ফিকিরেরও শেষ নেই তেমন।
      মনে ধরল না। যে পথে হাঁটতে গেলে আগে নিজেকে পাট পাট করে, ভাঁজ করে করে ছোটো করে নিতে হয়, তারপর ট্যাঁকে গুঁজে হিসাব কষে কষে খরচ করতে হয়, সেও খুব একটা যুক্তির কথা নয়। এক্ষেত্রে যেহেতু মানুষ চিত্তের সামগ্রী কিছুই পায় না সবাইকে ব্যবহার করতে করতে, তাই ভাবে সে বেশ জিতে গেছে আর কি। আসলে যে শুরু থেকেই হেরে বসে আছে, কারোর কাছে কিচ্ছুটি পায়নি, সে বুঝবে কি করে নিজে? বাইরের পাওনাগুলো গুনতে গুনতে ভিতরে যে কত দরিদ্র হয়ে পড়েছে সে আর বলতে? আমার একটা খুব দুষ্টু উপমা মনে এলো। মজার কথা যদিও। গ্রামে নাকি মহিলারা যখন বাহ্যে বসেন মাঠে, গুরুজন কেউ সামনে এসে পড়লেই, মাথার কাপড়টা লজ্জায় মাথায় ঢেকে নেন, যাতে সেই সেই গুরুজন চিনতে না পারেন, তার ফলে তার মুখটা চেনার জো থাকে না সত্যি, কিন্তু পশ্চাতদেশ উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। এই জাতীয় আত্মরক্ষকদের দেখলেই আমার খানিক তাদের গল্প মনে পড়ে। অর্থাৎ এ পথেও হাঁটা হল না।
 
প্রস্তাব – ৩) জগৎ তো এমনিই/ কেউ কথা রাখেনি
 
 
এ এক ধরণের ছিঁচকাঁদুনে দার্শনিকের দল। এদের মতে তারা ছাড়া সংসারে মনুষ্যপদবাচ্য কেউ নেই। অবশ্য যতক্ষণ আপনি সামনে থাকবেন আপনাকেও তাদের দলে রাখবে। তাদের শ্রেণীগত বৈষম্যবোধ একবারেই নেই। একটু মন দিয়ে নিন্দামন্দ শোনার অভ্যাস রপ্ত করতে পারলেই হল। এই সব বাড়ির কাজের মানুষদের পোয়াবারো দেখেছি। তারা গালে হাত দিয়ে পাত পেড়ে নিন্দামন্দ শুনবে, সায় দেবে, সময় বিশেষে কাঁদবে, দীর্ঘশ্বাস ফেলবে। ফলে সেই অসম্ভব রকমের বঞ্চিত মানুষগুলোকে তারা একটা ভেন্ট দেবে, নিজেও পার্থিব জগতে লাভবান হবে। আমি অনেক সময়েই দেখেছি প্রাক বৈবাহিক প্রেমে ছেলেটি মেয়েটির বাড়িতে মেয়েটিকে নির্যাতনের কথা শুনে এমন শোকে ডুবেছে যে স্বয়ং অর্জুনও সামনে নিজের জ্ঞাতিগুষ্ঠী দেখে অতটা শোকে নিমজ্জিত হয়েছিল কিনা সন্দেহ। তারপর বিবাহ পশ্চাৎ নিজের পরিবারের মানুষদের অবিবেচনা এমন পষ্ট করে দেখতে শুরু করল যে প্রায় মহাভারত শুরু হয় আর কি। ক্রমে মহাভারতের দিক বদলালো। একপক্ষ রাতারাতি নির্দোষ প্রমাণিত হল, আরেক পক্ষ রাতারাতিই কাঠগোড়ায় বাসা বাঁধল। 
      এই ছিঁচকাঁদুনে দর্শন বড় ভয়ংকর দর্শন। এ চিরকাল ঘেন্নার বস্তু, আজও তা। পাত পেড়ে নিন্দা শোনার চাইতে, পিছন উল্টে ঘুমানো অনেক বেশি স্বাস্থ্যকর বলে আমি অন্তত মনে করি।
 
প্রস্তাব – ৪) কর্মফল ও ঈশ্বরের ইচ্ছা
 
এ আরেক ঘোড়েল প্রস্তাব। সবই কপালের লেখন বাবা। যেন ঈশ্বর বাঁশবাগানের মালিক। সারাদিন সে ভদ্রলোকের বাঁশ কেটে কেটে লোকের বাড়ি ডেলিভারি দেওয়া ছাড়া আর কোনো কাজ নেই। এ সূত্রের উৎসই যখন এত গোলমেলে তখন একে না ঘাঁটানোই ভালো। শুধু নিজের অভিজ্ঞতাটুকু বলে নিই, যে এক্কেরে খাঁটি অদৃষ্টবাদী দেখার সৌভাগ্য আমার আজ অবধি হয়নি। স্বার্থের কোর রিজিয়নে ঝড় এসে পড়লে 'রে রে' করে তেড়ে যান, অন্যের কোর অঞ্চল উপড়ে গেলেও বিন্দুমাত্র বিচলিত হন না। নিশ্চিন্তে বলেন, ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই হয়েছে। এরকম নিষ্ঠুর ধর্মীয় প্রজাতির মানুষ দেখে দেখে চোখে শ্যাওলা জমে গেল। এদের কথা এখানেই ইতি।
 
প্রস্তাব – ৫) সত্যেরে লও সহজে
 
 
এই একটা কথাতে মন দাঁড়াল। ‘সত্য’ একটা অমোঘ শব্দ। সত্য কাকে বলে এ নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই তেমন। যেমন চোখের গঠন না জানলেও যা দেখছি তা নিয়ে সংশয় হয় না। তেমনই সত্যের সংজ্ঞা না জানলেও সত্যের বোধে সত্যকে চিনে নিতে তো অসুবিধা হয় না। সত্য বোধে সত্যকে নিয়ে চলার কথাটাকে দর্শনে বলে নরম্যাটিভ এথিক্স। বাকি সত্য কাকে বলে ইত্যাদি মেটা-এথিক্স নিয়ে মাথা ঘামিয়েও লাভ নেই, আবার বর্ণনাত্মক ও বস্তুনির্দিষ্ট এথিক্স নিয়েও খুব একটা ঘাঁটাঘাঁটি নিত্য জীবনে কাজে লাগে না, যদি না কলেজে ওই সব পড়িয়ে মান আর পেট চালাতে হয়। কারণ দুই চালাতেই অর্থের দরকার আগে, শীলবন্ত না হলেও চলে। 
      শুরুটা যা দিয়ে করেছিলাম, নিজের হাতে কতটুকুই আর আছে? এখন কথা হচ্ছে যে কাজটা কি খুব সোজা? না মোটেও না। তা বলে কি কাউকে নকশা কেটে হত্যা করে ফেলা, নিজের জীবনটা শেষ করে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া, সারাদিন হাপিত্যেশ করে বুক চাপড়ে মরাটা খুব সোজা কাজ বা কাজের কথা? 
 
      মানলাম ক্ষোভ-রাগ-অভিমান ইত্যাদি আবেগের শক্তি অত্যন্ত বেশি। তার যন্ত্রণাও অত্যন্ত বেশি। কিন্তু ধৈর্য্য বলেও তো একটা মানবিক গুণ মানুষের অনুশীলনের মধ্যেই পড়ে। ক্ষতিকর তীব্র আবেগকে কোন দর্শন, কোন যুক্তি আটকিয়েছে? না সেই সময় কোনো যুক্তি মাথায় কাজ করে? যা কাজ করে তা নিটোল ধৈর্য্য। সে ধৈর্য্যের শক্তি আসে সেই আঘাতের সত্য থেকেই, যে সত্যকে সহজে মেনে নেওয়ার কথা বলে যাওয়া হচ্ছে সেই কবে থেকে। একজন বলেছিলেন, ভাগ্য আমায় লেবু ছুঁড়ে মারলে সে লেবু দিয়ে আমি লেমোনেড বানিয়ে নেব। কথাটা মনে ধরেছিল। সত্যিই সে লেমোনেডের স্বাদ জীবনে যদি না-ই পাওয়া গেল, তবে আর হইলো ডা কি। তবে আর মহাভারত লিখে ব্যসদেব মহাকবি মহাজ্ঞানী মহামুনি কেন হতে গেলেন? অবশেষে যুধিষ্ঠিরের সাথে কুকুরটাকে পাঠাবার কথা ভাবতে পেরেছিলেন বলেই না?