সৌরভ ভট্টাচার্য
6 March 2017
আচ্ছা নারীবাদ বলতে কি, এক বিশেষ প্রকার যৌনতন্ত্র বিশিষ্ট, ইস্ট্রোজেন-প্রোজেস্টরণ কবলিত এক প্রকার প্রাণীকূলের কথা বোঝায় না মানবতার একটা বড় অংশকে বোঝায়? মানবসত্তার যে দিকটা এক গোলার্ধে তার মতন করে বিকশিত হতে চাইছে অথচ হতে দেওয়া হচ্ছে না, তার বিরুদ্ধে বলার কথাকেই আমি বলতে চাইছি। সমস্যা হল পৌরুষ বলতে যা বোঝায় তাতে মনে হয়, মানবিকতা থেকে বাদ দিলে যে প্রকাণ্ড অনিয়ন্ত্রিত শক্তির দাপট থাকে তার কথা বলা হচ্ছে। তার কারণ আমার মনে হয়, এই ছেলে হয়ে ওঠার ধারণাটা অনেকটা আরোপিত। একদিকে যেমন সমস্ত কোমল অনুভূতি, ভাবাবেগকে দমনের কৌশল যাকে বলি পুরুষ করে তোলা, অন্যদিকে তেমন সমস্ত কোমলগুণ, পরনির্ভরশীলতা ইত্যাদিতে প্রচণ্ড জোর দিয়ে মেয়ে করে তোলার প্রয়াস, তাও ততটাই যতটা ওই অসামঞ্জস্য পূর্ণ পুরুষত্বের ভোগ্য হয়ে ওঠা যায়। এর মাঝখানে মানবধর্মটিকেও যতটা কৌশলে (সে ধর্মের হোক কি রাষ্ট্রের) দমন করে নিজের মত গড়েপিটে নেওয়া যায় তার প্রবণতা। পুরো ইতিহাসটা এমন না হলেও, একটা বড় অংশ ইতিহাসের এমনই মানবসভ্যতার।
কিছু কি পাল্টাচ্ছে? না old wine in new bottle হয়ে যাচ্ছে সবকিছু। মনে তো হয় বদলাচ্ছে। যদি সে বদলায়ও তবে তা কি স্লোগানে, সেমিনারে বদলাবে? বারবার আমার মনে হয়, না। সেরকম ভাবে বদলাবে না। ভাবনা বদলাতে হবে। ভাবনা বদলায় ভাবাতে শুরু করলে। ভাবাতে শুরু করে চরিত্র, তত্ত্ব না। অস্তিত্বের শক্তিতে যা দাঁড়ায় তাই চরিত্র। চরিত্র অক্ষরে কথা বলে না, চরিত্র কথা বলে সময় আর সমাজের মাত্রার মধ্যে নিজেকে খাপ খাইয়ে, প্রকাশ ক'রে নিজের অস্তিত্বের নীরব স্ব-অভিমানের বলে। সে ভাঙে আর গড়ে একই সাথে, একই হাতে। একটু সেকেলে কথাই না হয় বলি। সীতা চরিত্র আমায় বরাবর ভীষণ বিস্মিত করে এই কারণেই। তিনি লঙ্কায়, কি মুনির আশ্রমে, কি অযোধ্যায় নিজের সম্মানের সাথে একবিন্দু আপোস করলেন না। সারাটা জীবন কতটা সুখ পেলেন কি কতটা দুঃখ পেলেন সেটা মানব ইতিহাসে বড় কথা নয়। সুখই যদি পরম সফলতার পরাকাষ্ঠা হত তবে প্রথম যে মানুষটা শত সমস্যা সহ্য করে, প্রাণ হাতে করে এভারেস্টে উঠেছিল তার নাম না করে, যে শ্যামবাজারের বাড়িতে ঘুমিয়ে, দাওয়ায় আড্ডা মেরে পুরো জীবন কাটালো তাকে বাহবা দিতুম। তাই যখন চরম মুহুর্তটা এলো সীতার জীবনে তখন নিজেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়াটাই যুক্তিযুক্ত মনে করলেন। এটাই প্রতিবাদ। প্রতিবাদের মাত্রাটা ঠিক করে সমাজ আর সময়ের পরিস্থিতি। তাতে সত্যিকারের কাজটা হয়। না হলে আওয়াজ যত হয়, ধুলো যত ওড়ে, কাজ তত হয় না। অবিশ্যি রবি ঠাকুরের মতে - অনেকে জলে নেমে হাত-পা কে কতটা ছুঁড়তে পারে তার উপরেই তার সাঁতারের দক্ষতা ঠাওরায়, কতটা দক্ষতায় জলটা পার হল সেটা বড় কথা না।
তাই লোকচক্ষুর আড়ালে, বিনা হাততালিতে আত্ম-সম্মানকে মরতে না দেওয়ার যে লড়াই, তাকেই আমার বড় কঠিন আর খাঁটি লড়াই বলে মনে হয়। মনে হয় শিশিরপাতের মত তাদের সংগ্রামেই ধুয়ে যাবে মানব চেতনভূমির ওপর যে জড় আস্তরণ তার। তাদের কথাই বলতে হবে। আরো আরো বেশি করে বলতে হবে, লিখতে হবে। সেই অর্থে আমি একশোবার কেন লক্ষকোটিবার নারীবাদী। আমার মাকে বাবার ভূমিকায় দেখতে চাইনি কোনোদিন, মাকে মায়ের ভূমিকায় স্পষ্ট দেখেছি। সেখানেই মা সার্থক। আজ মাকে একজন নারী হিসাবেও দেখি, তিনি আর তাঁর মা, মানে আমার দিদা(কেউই নেই যদিও আজ) নিজেদের চিন্তায়, নীতিতে, সংযমে অত্যন্ত স্পষ্ট, স্বচ্ছ ছিলেন। সংযম কথাটা আত্ম-সম্মান রাখার ক্ষেত্রে সব চাইতে জরুরী দেখেছি। কোথায় থামলে নিজের ক্ষতি হবে না, এইটা না বুঝলে হয় দুর্ঘটনায় থামতে হয়, না তো অন্যে এসে থামায়, আর সেই সুযোগে সে আমার উপর নিয়ন্ত্রণের অধিকারটুকুও পেয়ে যায়। সেটাই দুর্বলতা। কিন্তু সেটাই শেষ কথা না। হতে পারে না। কোনো মোহ না - না তো অতিশক্তির, না তো অক্ষমতার – সংসারে উস্কানো আর দাবানো দুই দলের লোকই উপস্থিত, পায়ের মাপ না জানলে ভুল চটি পরে রাস্তায় হোঁচট খাওয়ার সম্ভাবনাও প্রবল। ওই যে কে একজন বলেছিলেন না - স্বাধীনতা মানে যা খুশী তাই করাকে বলে না, যেটা করা উচিৎ সেটাই করার পরিবেশটাকে বোঝায়।
তাই আমি সে সমস্ত লড়াইগুলোর কথা লিখবই, কেউ না পড়লেও লিখব। অন্ততঃ নিজের কাছে নিজের মুখ দেখানোর ব্যবস্থাটা তো করা থাক! আমার কাছে গর্ভঋণ আর দুগ্ধঋণ তথা স্নেহ-প্রশ্রয়-আদরগুলোর ঋণ, বীর্যঋণের চেয়ে অনেকাংশে দামী। ছোট করছি না কাউকেই, শুধু মাপটা বলছি আমার চোখে। এক সীতা দিয়ে আমি পুরো জগৎ কল্পনা করতে পারি, শতকোটি রাম দিয়েও পারি না, এক সীতা কম পড়ে ( এ তত্ত্ব বুঝতে ঋণস্বীকার - বিবেকানন্দ)।
আরেকটা কথা। বর্বরতা, ক্রুরতা, নিষ্ঠুরতা, পৈশুন্য ইত্যাদি কোনোদিন পৃথিবী ছেড়ে যাবে না, এ অকাট্য সত্য। লড়াইটায় নামার আগে তাই এটা মেনে নিই, না হলে তাড়াতাড়ি হতাশা আসবে। মানতে হবে, অন্ধকারকে নিশ্চিহ্ন করতে পারব না, ঠেকিয়ে তো রাখতে পারব!