একজন আমার কাছে খুব দুঃখ করত, "দেখো আমাদের একান্নবর্তী পরিবার। আজকাল তো দেখাই যায় না এরকম। কিন্তু কেমন যেন সব ছাড়াছাড়া। কেউ কারোর ঘরে আসে না। সব আলাদা আলাদা রান্না। ভালো লাগে না।"
আমি শুনে, 'হাঁ, হুঁ' বলতাম।
এখন হল কি, তাদের পরিবারে এক ঘরে করোনা হল। শুধু সেই ঘরের লোকেদেরই পজিটিভ এলো। পরিবারের বাদবাকি সবার নেগেটিভ।
সে আবার যখন এলো, আমি বললুম, দেখো, সব কিছুরই একটা ভালো দিক থাকে। এই যে তোমাদের বাড়িতে সবাই ছাড়াছাড়া বলে দুঃখু করো, কিন্তু সেই বলেই না গুষ্টিশুদ্ধ পজিটিভ হলে না! নইলে সব শুদ্ধ বিছানায় শুয়ে থাকলে কে কাকে দেখতো বলো? সব সময় ভালো দিকটা দেখতে হয়। নয় কি?"
সে কটমট করে আমার দিকে তাকালো। চলে গেল। আমিও আমার সুক্ষ্ম দর্শনের উদ্ভাবনের আনন্দে পুলকিত হয়ে অদ্বৈত বেদান্তটা আবার পড়ব কিনা ভাবছি, হঠাৎ স্বামীজির একটা লাইনে চোখ গেল।
জগত সংসার রান্নাঘরের আগুন। রাঁধতেও পারো, ছ্যাঁকা খেতেও পারো।
বেশ লাইন। মায় মশারি টাঙানোর না অভ্যাসে কত কত প্রাণ ম্যালেরিয়ায় চলে যায়, শুধুমাত্র ORS -এর ব্যবহার না জানাতে কত কত বাচ্চা অকালে প্রাণ হারায়, কিম্বা জলে ক্লোরিন দিয়ে শুদ্ধ করার অভ্যাসের অভাবে কত কত বাচ্চা মারা যায় পৃথিবীতে, এ কথা পরিসংখ্যান দিয়ে অভিজিৎবাবু লিখেছেন তো 'Poor Economics' বইতে। এ সবই হল জগত সংসারের ছ্যাঁকা। বিজ্ঞান হল বাইরের ছ্যাঁকার ঠেকান, আর দর্শন হল অন্তরের ছ্যাঁকার হাত থেকে বাঁচার উপায়। অন্তরের দর্শন বলে, মানে প্রাণে কিঞ্চিৎ বৈরাগ্য না থাকলে সংসারে ল্যাজেগোবরে হয়ে বাঁচায় আর কি সুখ? রামকৃষ্ণদেব বলতেন, তেল মেখে কাঁঠাল ভাঙো। ভাগবতে আছে, জুতো পায়ে কাঁটাবনে হাঁটো। জুতো মানে কি? সন্তোষ। মানে কি? আধুনিক মনোবিজ্ঞান বলছে, ভাই ক্রিটিকালি ভাবো? সম্পূর্ণ হৃদয় ডিপোজিট করে বোসো না ধুম করে। শেষে দেউলিয়া ঘোষণা করতে হবে। বাইরে ফকির মনে রাজা, এ বেশ। এই যে দেখলে না, গুরু-শিষ্য'র জমি নিয়ে কোন্দলে, গুরু গলায় দড়ি দিয়েই মারা গেলেন। আরে নরেন্দ্র গিরির কথা বলছি। ওদিকে শিষ্যের যা ঠাটবাট বাবা! তো অমন বৈরাগ্যের মুখে ঝাঁটা।
কিন্তু সংসারে চলতে গেলে অল্পস্বল্প বৈরাগ্য না থাকলে বুদ্ধি খোলতাই হয় না। বাড়াবাড়ি কিছুরই ভালো না, সে অতিরিক্ত মাখামাখাই বলো, আর একদম শ্মশানবাসীই হওয়া বলো, দুই কি ভালো? এই যে নোবেল পাওয়া দাদা-বৌদি বিশ্বসংসার ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছেন, মায় তথ্য, পরিসংখ্যান দিয়ে দেখাচ্ছেন, গরীব মানুষদের অবিমৃশ্যকারীর মত খচ্চাপাতির কথা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ইত্যাদি নিয়ে নানা কুসংস্কার, অসহায়ত্ব ইত্যাদির কথা। আমরা ক'জন জানতাম যে ভারতের অমন পশ্চিমপ্রান্তে হাতুড়ে ডাক্তারদের 'বাঙালি ডাক্তার' বলে? কারণ তখন বেশিরভাগ বাঙালিরাই নাকি সারা ভারতে এখানে সেখানে ডাক্তারি করতে যেতেন। কারণ প্রথম মেডিকেল কলেজ তো কলকাতাতেই হয়েছিল না! তো সে যাই হোক, মানুষকে গভীরভাবে দেখতে গেলে, জানতে গেলে তাকে বৈরাগ্য আর অনুকম্পা - দুইয়ের নিরিখেই দেখা লাগে। নইলে ভুল জাজমেন্ট হয়ে যায়। অভিজিৎবাবু'র কাজ অন্তত তাই বলে। কর্তব্যটা কর্তব্যই। সেখানে গদগদ আবেগের চাইতে অন্তর্দৃষ্টি আর বিচার বিশ্লেষণ শক্তির ডাক বেশি পড়ে।
তো যদি স্বামীজির চিঠিগুলো পড়া যায়, দেখা যায় ওখানেও উনি বারবার শুদ্ধ পানীয়জল ইত্যাদির কথা বলছেন। এমনকি ওঁর শেষদিনেও সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় বলে গেলেন, মঠের জন্য মশারি কিনতে হবে, নইলে ম্যালেরিয়া ঠেকানো যাবে না। এ প্রসঙ্গে অনেকেই নিশ্চয়ই জানেন রবীন্দ্রনাথেরও ম্যালেরিয়া নিয়ে বেশ বড় একটা প্রবন্ধ আছে। মানে কথা হল শুধু দার্শনিক হলে হয় না, ম্যালেরিয়াতত্ত্বও জানা লাগে।
তবে এই হল কথা। যদিও সংসার একান্নবর্তী পরিবার। একে অন্যের সুখদুখ নিয়ে যেমন ভাবনা চিন্তা করা দরকার, তেমনই একটু দূরত্বও রাখতে হবে। যাকে এখন বলে 'স্পেস দিতে'। ওই স্পেশটুকুই হল বৈরাগ্য। এটা-একটা নো চিন্তা, নো স্বার্থ, নো পরমার্থ জোন। সেখানে শুধু ফুরফুরে হাওয়া, আর মুক্ত বাতাস থাকবে। হাঁপিয়ে গেলে, মধ্যে মধ্যে সেখানে দাঁড়িয়ে আসতে হবে। এ স্বাস্থ্যকর অভ্যাস। এর পরিসংখ্যান অর্থনীতিতে পাওয়া যায় না। জীবন হল পরিমাপযোগ্য আর অপরিমাপযোগ্য তত্ত্বের মিশ্রণ। একটাকে বড় করে দেখলে আরেকটা তো বেসামাল হবেই। তাতে গোটা জীবনই বেসামাল। নয় কি? নইলে স্বামীজি কেন বলছেন, আগে গ্রামে গ্রামে যাও, গিয়ে গ্লোব, রাসায়নিক পদার্থ ইত্যাদি নিয়ে গিয়ে মানুষকে প্রাথমিক বিজ্ঞান আর স্বাস্থ্যের শিক্ষাটা দাও। ফি বছর কাতারে কাতারে বাচ্চা পেড়ে জনক রাজা না হয়ে একটু স্বাস্থ্য নিয়েও ভাবা দরকার।
এই হল কথা। কাণ্ডজ্ঞান না হারিয়ে সংসারে চললে সবটুকুই থাকে --- ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ। মানে নীতি, টাকা-পয়সা, বাসনা-ইচ্ছা-শখ-আহ্লাদ আর স্বীয় সত্তার সার্থকতামণ্ডিত অনুভব, ইংরাজিতে যাকে বলে 'সেল্ফ অ্যাকচুয়ালাইজেশান'।