Skip to main content

শব্দের দায়িত্ব কি? শব্দ থেকে বাক্য। বাক্য জুড়ে চিন্তার ভাষা। চিন্তা-ভাবনা-কল্পনা কেন? আত্মতোষণ, রাজশক্তি তোষণ, জনপ্রিয় মতামত তোষণ, প্রচলিত ধারণা-বিশ্বাস তোষণ?
      যুক্তি কার উপর দাঁড়িয়ে? কান্টের মতে যুক্তি শুধু অভিজ্ঞতা নির্ভর নয়, মানুষের মধ্যে একটা বিশ্বজনীন উদার যুক্তির সপক্ষে ‘হাঁ’ থাকে। ক্যাটাগরিকাল ইম্পারেটিভ। কিন্তু আমি কি একটা কঠিন তত্ত্ব আওড়াতে লিখতে বসলাম? না তো।
      আমি লিখতে বসলাম শব্দের ধারভার বোঝার জন্য। আমি লিখতে বসলাম, আমি কিভাবে লিখব সেটা খোঁজার জন্য। আমাদের অস্তিত্বের একটা জৈবিক দিক আছে আরেকটা বৌদ্ধিক দিক আছে। আবেগকে আমি বৌদ্ধিক স্তরের প্রজা হিসাবেই দেখি, তার শক্তি আছে কিন্তু দিশা নেই। বুদ্ধি বলতে আমি প্রজ্ঞা-স্বজ্ঞা মিলিত মানুষের যুক্তি আলোকিত অস্তিত্বটির কথা বলছি।


      যুক্তির এক ধরণের কাজের ধারায় আসে কার্য-কারণ সূত্র ধরে সত্যের অন্বেষণ। অবশ্যই ডেভিড হিউমের হতাশার কারণ আছে, কারণ সেই পথে আমরা বেশি দূর এগোতে পারি না। কিছুদূর এগিয়ে সব ঝাপসা। তবে কার্যকারণ পথের বাইরে আরেক ধারার অন্বেষণে মানুষ শুধু নিজের যুক্তিকে মন্থন করে সত্যের আলোর উৎসের খোঁজ পেয়েছে, সেও আছে। বিজ্ঞানের প্রায় সমস্ত সূত্রের একটা বড় অংশ আমাদের যুক্তির মন্থনে। বাহ্যিক ঘটনা কিছু কিছু ক্ষেত্রে উদ্দীপক মাত্র। বিজ্ঞানের গতিপথ যত সূক্ষ্ম, যত গভীর, তার বাহ্যিক নির্ভরশীলতা তত কম, সে তত বেশি সফিস্টেকেটেড।
      মানুষের অস্তিত্বের একটা বড় অংশ জুড়ে থাকে যুক্তি আর জৈবিক স্তরের মধ্যে সুখের অন্বেষণ। অন্য অর্থে মানুষ সেখানে স্বেচ্ছাবন্দী। তার জৈবিক প্রয়োজন অর্থাৎ ক্ষুধা, তৃষ্ণা, আচ্ছাদন, আবাস, কাম ইত্যাদির প্রয়োজন মিটে গেলে সে তখন নানা আবেগজাত সুখে ব্যস্ত। সে জগতে স্বল্প বৌদ্ধিক, যুক্তির আনাগোনা থাকে, কিন্তু সেখানে সুখটাই প্রধান কথা। আমি যখন দাবার ছক সাজিয়ে বসছি, বা একটা উপন্যাস কি গল্প লিখছি, বা পড়ছি, বা একটা ছবি আঁকছি, দেখছি বা তর্কযুদ্ধে নেমেছি, সে সবই মনের আবেগের রাজ্যে সুখের বোধ আমায় চালিত করছে। বুদ্ধি সেখানে আজ্ঞাবাহকের ভূমিকায়। সুখ কর্তা। সুখের কোনো কর্তব্যবোধ নেই। তাই তর্কে আত্মপ্রতিষ্ঠার সুখ, সাহিত্যে নানা চরিত্রের মধ্যে, নানা ঘটনাপঞ্জীর মধ্যে, নানা ভাবে সত্যকে বিকৃত, পীড়িত করে সেই সুখের আমোদে সে ঘুরে ফিরছে। এ সুখ অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, বাজারি বৌদ্ধিক-তর্জা ইত্যাদিতে আমাদের নানাভাবে মোহিত করে রেখে যাচ্ছে, কিন্তু নির্মোহ নির্মম সত্যের আলোর কাছাকাছি আনার কোনো দায় তার নেই।
      আমরা সেই সময় দিয়ে এগোচ্ছি যখন বুদ্ধি, তার স্বজ্ঞা-প্রজ্ঞা সমস্ত জলাঞ্জলি দিয়ে তার সৃষ্টির মূলে যে স্বার্থহীন কর্তব্যের তাড়না তা ভুলে আবেগের যাদুকাঠিতে, বা তার নিজের নিম্মস্তরের অস্তিত্বের স্ব-সম্মোহনে দিশাহীন ছুটে চলেছে।
যে কর্তব্যের কথা বললাম, সে কার প্রতি কর্তব্য? এর উত্তর সোজা, কিন্তু কঠিন, কর্তব্যের প্রতিই কর্তব্য। বারবার আলোচনায় আসছে সারা পৃথিবী জুড়ে আজ বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি তথা, মৌলবাদী শক্তির আবির্ভাব। আমাদের বারবার বিস্ময় জাগছে কেন হচ্ছে? কিন্তু হবে না-ই বা কেন? মানুষের নানা বিভ্রমের হাত থেকে মানুষকে যারা বৌদ্ধিক স্তরে, চেতনার স্তরে জাগতে বলেছেন, তারা বারবার রাজরোষে পড়েছেন, সেদিনের সক্রেটিস, ব্রুনো হোক কি আমাদের এখনকার গৌরী লঙ্কেশ থেকে রোমিলা থাপার। রাজনীতি আর ধর্মনীতির সব চাইতে বড় শক্তি হল তার জনগণের উপর প্রভাব। তবে কি জনগণ বোকা? বোকা না বিভ্রান্ত, সংখ্যাগরিষ্ঠতাক্রান্ত। তাই আজও সামান্য সিনেমা দেখতে যাওয়ার আগে IMDB, Rotten Tomato-র rating-এর উপর নির্ভর করতে হয়। জনগণের রায়কে ধ্রুব জেনে শাসক সত্যের ঘোড়ায় লাগাম পরান।
      মিথ্যাকে চেনা সোজা, ভ্রান্তিকে চিনতে গেলে প্রজ্ঞা লাগে। প্রজ্ঞার দিকে মানুষ তখনই তাকায় যখন সে নিজের বুদ্ধি-বিবেকের প্রতি কর্তব্যপরায়ণ, দায়বদ্ধ। কিন্তু জনসাধারণের সে দায় নেই। কোনোদিনই ছিল না। তারা যখন বিপ্লব করে, তখন বুঝতে হবে কোন মানুষ তাদের প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছেন।
      সেই প্রভাবকের আবার প্রকার আছে। কেউ মানুষকে মানুষ দেখেন, কেউ প্রজা। কেউ সবার ঘরে আলোর ব্যবস্থা করতে চান, কেউ একটা বড় মশালের আলোর নীচে সবাইকে চান জড়ো করতে। মাঝে মাঝেই ভয় দেখান মশাল নিভিয়ে দেওয়ার। অগত্যা সবাই মশালের অনুগত হয়ে যায়। কেউ ঘরে আলো জ্বালতে গেলেই তখন জনতাই 'রে রে' করে তেড়ে যান, পাছে মশালটা নিভিয়ে দেয় রাজা। সংবাদপত্র, সিনেমা, বিজ্ঞাপন, সাহিত্য --- সবাই সেই মশালের অনুগত তখন। মশালের উষ্ণতা, মশালের আলো, মশালের গর্ব, মশালের স্নেহ এমন মায়াময় একটা সোনার শৃঙ্খল তৈরি করে ফেলে যে তাকে ছিঁড়ে ফেলতে চাওয়া অনৈতিক বলে বোধ হয়, বেইমানি বলে বোধ হয়। আর বোধটাকে সার্থকভাবে জাগিয়ে দেওয়াই রাজার সফলতা। তখন প্রজাদের এক স্তর তৈরি হয় যারা রাজার অনুচর, উপরাজা। তাদের শাসন আরো তীক্ষ্ম, আরো স্থূল, আরো শক্তির প্রদর্শন।
      আর যে মানুষ প্রতি ঘরে আলো জ্বালবার কথা বলে? সে সার্বজনীন বিধানে বিশ্বাসী। সে বিধানের শক্তিতে একজন ভিখারিকে স্টেশানে বসে নিজের খাবারের অংশ কুকুরদের সাথে ভাগ করে নিতে দেখা যায়, নিজেকে অভুক্ত রেখেও নিজের শিশুকে খাবার জুগিয়ে যায়। এর ব্যতিক্রমও আছে, ব্যতিক্রম হিসাবেই আছে। তাই থাকবেও।

      এমন মানুষ কেউ কেউ আসেন যারা মানুষকে সেই সার্বজনীন বিশ্বাসের মধ্যে নিয়ে আসার ব্রত নেন, তারা যুগে যুগে ব্যর্থ হন। সেই ব্যর্থতা সাময়িক নিরিখে। কিন্তু চিরকালের স্রোতে তাদের কাজ নিঃশব্দে চলতেই থাকে, চলতেই থাকে। রবীন্দ্রনাথ একটা চিঠিতে অমিয় চক্রবর্তীকে লিখছেন যে মননের জগতে তিনি মহাত্মার সাথে অনেক ক্ষেত্রে ভিন্নমত পোষণ করেন, তিনি স্বয়ং কাজের জগতে এলে হয়ত অন্যভাবে কাজ করতেন, কিন্তু তিনি বলেছেন যে তার সে প্রভাব নেই জনমানসে, যা মহাত্মা ও সুভাষের আছে। সেই চিঠিতে তিনি তাই সুভাষ ও মহাত্মার উপর আস্থা রাখার কথা বলছেন, পাশাপাশি এও বলছেন, সামনে আরো অনেক অনেক ঘাট আছে, আরো নতুন নতুন মাঝির আবির্ভাবও হবে। কিন্তু আমরা যেন অন্ধভক্তের মত "এই শেষ ঘাট" বলে বসে না পড়ি। রবীন্দ্রনাথ এইখানেই আমাদের মুক্ত করেন তথ্যের শিকল খুলে বোধের স্রোত এগিয়ে দিতে।
      আসলে সত্য তো ব্যক্তির উপর নির্ভর করে না, সে স্বয়ংবেদ্য, স্বয়ংম্ভূ। ব্যক্তিবিশেষের সীমাবদ্ধতায় সে সত্য বিকৃত হয়নি তা নয়, কিন্তু সেই মানুষের সাধারণের প্রতি কর্তব্যপরায়ণতার গতির সামনে বারবার ইতিহাস মাথা নীচু করেছে। সেই সময়ের সীমাবদ্ধতা, সেই মানুষের চিন্তাভাবনায় প্রভাব ফেলেছে হয়ত, কিন্তু তবু সে কোথাও সত্যের কিছুটা অংশকে নিজের চেতনায় প্রতিফলিত করতে তো পেরেছেন! বিজ্ঞান ও দর্শন এই পথেই ধাপে ধাপে এগিয়ে এসেছে। চূড়ান্ত সে কাউকেই বলেনি। কিন্তু সার্বজনীন সূত্রকে মেনে নিয়েছে।

      যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, বুদ্ধির আহরণের পথ। বুদ্ধির প্রতি নিঃশর্ত কর্তব্যপরায়ণতার সঙ্কল্প। সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে গেলে মতের সৃষ্টি হয়, পরে নিজেই যা একটা কারাগার হয়ে পড়ে। ভ্রান্তির কুয়াশার প্রতি নির্মোহ নির্মম হতে পারাই সত্যের শ্রেষ্ঠ উপাসনা। বর্ণাশ্রম, ওঝা, জ্যোতিষী, ধর্মীয় মৌলবাদ ইত্যাদি রোগের কারণ নয়, উপসর্গ। এ রোগাদির কারণ মোহ। ভ্রান্তিকে সত্য বলে জানা। ভ্রান্তির কপট নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতিতে সত্যের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকার মাশুল। আধুনিক সমাজ চাঁদের কক্ষপথে অবরোহনে নয়, ঝাঁ-চকচকে পথঘাটে নয়, আত্মমোহের সুখের মাদকতাতে নয়, অর্থনৈতিক অগ্রতিতেও নয়, সে সমাজ শুধুমাত্র শুভবুদ্ধির পাখাকে আকাশে মেলতে দেওয়াতে। বাকি যা কিছু শুভ আপনিই আসে।