লোক নিয়ে অনেক কথা রামকৃষ্ণদেবের অবজারভেশানে আছে---
১) লোক না পোক
===============
ধরুন রামকৃষ্ণদেবের সঙ্গে যদি দার্শনিক নীৎজের দেখা হত, যিনি ফস্ করে বলে বসেছিলেন, 'God is Dead', সেই মানুষটির যদি রামকৃষ্ণদেবের সঙ্গে দেখা হত তবে এই অবজারভেশনে দু'জনের দারুণ মিল হত। নীৎজের ভাষায় মানুষের দল হল, পশুর পালের মত। আজ যে আমরা এই 'হার্ড ইম্যুউনিটি' করে চিল্লাচ্ছি। এই সেই 'heard' শব্দ, শব্দটা নিঃসন্দেহে 'hard', তবে এই শব্দটাতে দু'জনের মিল আছে।
কখন বলতেন এই কথা, যখন মানুষের অগভীর মতামতের প্রসঙ্গ উঠত। মানে অগভীর জনতার মতামতের মূল্য আর কি। সে নিয়ে তো চন্দ্রিল মহাশয়েরও একখানা জবরদস্ত বক্তব্য আছে না, যেখানে উনি বলছেন 'পথের পাঁচালী'-র চাইতে 'বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না' সিনেমার পাব্লিক রেটিং বেশি!
এই নিয়ে সক্রেটিসের মতামতও এক। সেই যে গো, ওনার মৃত্যুর আগের দিন ওনার এক শিষ্যের সঙ্গে সারারাত কথা হল না? শিষ্য বারবার করে বললেন, চলেন দাদা পাইলে যাই…. আর সক্রেটিস ওকে বারবার করে বোঝালেন যে, না বাবা ওসব প্ল্যান করে লাভ নেই। সেখানেই তো বললেন, ওসব জনতার মতামতের গুরুত্ব কিছু নাই।
আজকাল অবশ্য আমরাও বলি, 'এক্সপার্টস্ ভিউ'। অর্থাৎ 'তবে একলা চলো রে'-এর বেলায় 'লোক না পোক' না ধরলে লোকের কথার জবাবদিহি করতে করতে জীবন জেরবার। সেই যে কামিনী রায়ের কবিতাটা মনে করুন, "পাছে লোকে কিছু বলে"। কি খাঁটি একখানা কবিতা না?
২) মনুমেন্টের মাথায় চড়লে লোকগুলো এই ক্ষুদে ক্ষুদে, সব মিশে এক
========================================================
এও এক কথা। উচ্চদর্শনের কথা। ভাবের কথা। যখন মানুষ কোনো শিক্ষার, কোনো সত্যের বড় ধাপে এসে দাঁড়ায় তখন ভেদবুদ্ধি আপনিই সরে যায়।
আচ্ছা এ কথাটা কি শুধু অধ্যাত্মবোধ প্রসঙ্গেই খাঁটি? তা নয়। দেখুন যে মানুষটা চিকিৎসক, সে মানুষটার কাছে কি আমাদের এই আপাত শ্রেণীবিন্যাসের কোনো মানে আছে? নেই। একটা বড় মঞ্চে নানা বৈচিত্র্যের সমাগম সেখানে। যেমন ধরুন রক্তের বিভাগ আছে, কিন্তু রক্তহীন মানুষ তো বলার জো নেই। কারো হৃৎপিণ্ড বাঁদিকে, কারোর ডানদিকে, কিন্তু হৃৎপিণ্ড নেই এ কথা তো কেউ বলবে না! তাই ঠাকুর বলতেন, সব মিশে এক হয়ে যায় গভীর দর্শনে বা তত্ত্বে। ব্যবহারিক জীবনে ভিন্নতা থাকবেই। যেমন, সব জলই জল। কিন্তু কোনোটা নর্দমার, কোনোটা পানীয়, কোনোটা কাচাকাচির, কোনোটা আচমনের ইত্যাদি। আরো উদাহরণ দিচ্ছেন, যেমন সবার মধ্যেই নারায়ণ আছেন। কিন্তু বাঘ নারায়ণকে দূর থেকে নমস্কার করতে হয়। কি খাঁটি কথা দেখুন। কয়েকটা মানুষ বাঘের খাঁচায় ঢুকে কি বেঘোরে প্রাণটা দিল দেখেছেন না ইউটিউবে? সেই তো, কেউ অমন টপ্ করে খাঁচায় ঢুকে মালা পরাতে যায় বাঘকে?
৩) ক্ষীরের পোর, কলাইয়ের পোর
===========================
এও আছে। কিছু মানুষের সঙ্গে কথা বললে কি হয়? প্রাণ জুড়িয়ে যায়। আর কিছু মানুষের সঙ্গে কথা বললে প্রাণ জ্বলে যায়। তুলসীদাসজী বলছেন না, সাধু অসাধু দু'জনেই দুঃখ দিতে ওস্তাদ। সাধু দেখা না দিয়ে, আর অসাধু দেখা দিয়ে। তো ঠাকুরের অবজারভেশানে, “মানুষগুলি দেখতে একরকম, কিন্তু ভিন্ন প্রকৃতি। ... পুলিগুলি দেখতে সব একরকম। কিন্তু কারু ভিতর ক্ষীরের পোর, কারু ভিতর নারিকেলের ছাঁচ, কারু ভিতর কলায়ের পোর।"
তা বলে কি দুষ্ট লোকের দরকার নেই? রামকৃষ্ণদেবের অবজারভেশান অনেক বাস্তবমুখী। উনি বলছেন, দেখো দুষ্ট লোক না হলে তালুক শাসন হত কি করে?
কি বাস্তব কথা, তাই তো! কূটবুদ্ধি, প্যাঁচালো বুদ্ধি ইত্যাদি না থাকলে কি আর রাজনীতিতে টেকা যায় বাপ! বলি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হেডমাষ্টারি করা আর একটা দেশের হেডমাষ্টারি করা কি এক নীতিতে হতে পারে? একজন হেডমাষ্টার যেভাবে ভালো মানুষ হতে পারেন, একজন দেশের প্রধান সেই অর্থে ‘ভালো মানুষ’ হলে কি হয়? তবে আর কূটনীতি বলা হচ্ছে কেন? তাই রামকৃষ্ণদেবের অবজারভেশানে কূটনীতির মানুষকেও দরকার। আরেক জায়গায় বলছেন, দেখো মূলটা কোনদিকে থাকে? অবশ্যই আমাদের উত্তর হবে নীচের দিকে থাকে। রামকৃষ্ণদেব বলছেন, মানুষের যেটা মূল, অর্থাৎ কিনা মাথাটা, সেইটাই গেল উপরের দিকে। কি আজব সৃষ্টি!
তবে গোলমেলে মানুষের সঙ্গে পাল্লা পড়লে কি করব? এখানে দুটো দাওয়াই দিচ্ছেন। প্রথম কথা, বাবা, কূটস্থ বুদ্ধি হতে হবে। কেমন? না কামারের ঘরে দেখোনি, অত জোরে জোরে নেহাই পড়ছে গরম লোহার উপর, তবু সে তা সহ্য করে যাচ্ছে। সেরকম। ঠাকুর আরেকটা উদাহরণ দিচ্ছেন, মানুষ যখন বনে থাকত, কি সাধুরা যে বনে-জঙ্গলে ধ্যান করে, সেখানে কি হিংস্র প্রাণী নেই? তবে সেরকম সমাজেও হিংস্র মানুষ থাকবে এ আর নতুন কথা কি? আমায় সতর্ক হতে হবে। কিভাবে? না বুদ্ধিকে স্থির রেখে। বুদ্ধি গুলিয়ে গেল তো হাত থেকে টর্চ পড়ে গেল। তখন তো আমি অন্ধকারের খপ্পরে পড়েই গেলাম না? তাই হাতটা শক্ত রাখতে হবে, মানে বুদ্ধিটা স্থির রাখতে হবে। যেন টর্চ হাত থেকে পড়ে না যায়। বুদ্ধি যেন যুক্তির শৃঙ্খলা ভেঙে ভেসে না যায়। বুদ্ধি স্থির রাখলে কি হবে? ফোঁস করবে কিন্তু বিষ না ঢালার ক্ষমতা জন্মাবে। কালেভদ্রে ফোঁস যে করতেই হবে সে কথা ঠাকুর আমাদের ভালো করে শিখিয়েই গেলেন। রম্যাঁ রলাঁ বলছেন, এক গালে চড় খেলে আরেক গাল বাড়িয়ে দিয়ে চড় খাওয়ার যে শিক্ষে খ্রীষ্ট দিয়েছেন, সেকি আর সব জায়গায় কাজে আসে? তাই রামকৃষ্ণদেব, রম্যাঁ রলাঁ'র ভাষায় “খ্রীষ্টের ছোটোভাই”, এই শিক্ষা দিয়েছেন যাতে করে সংসারে নিজের রাস্তাটা নিজে বুঝে নিয়ে চলা যায়। ওই যে বললাম, বাস্তবমুখী শিক্ষা।
৪) বালিশের ওয়াড় ও উদ্দীপন
======================
এ এক অদ্ভুত দর্শন। মানুষগুলো যেন বালিশের ওয়াড় পরানো এক চৈতন্য, ঠাকুরের মা, সচ্চিদানন্দ। ভিতরে তুলো সব এক। মানুষ প্রকৃতিতে যা কিছুর পোরই হোক না কেন, ক্ষীর কি কলাইয়ের, সব শেষে তো সব মা! এই জায়গায় বুঝি না। সে তো আকাশ অসীম, অণু-পরমাণু কিছুই বুঝি না। অ্যাদ্দিন যা পড়াশোনা করে বড় হলাম, তার কতটুকু বুঝলাম? হিসাব করে দেখলে হয় তো কিছুই না। কিন্তু আমার বোঝাবুঝির উপর নির্ভর করে তো আর জগতে মহতের অস্তিত্ব নয়। তাই ঠাকুরের এই কথা, এই চরিত্র বড় অদ্ভুত। কাউকে বলছেন, তোমার তো অত টাকা ওদের গ্রামে এত জলের কষ্ট, একটা পুকুর খুঁড়ে দাও না। আবার নিজের স্ত্রী-কে জিজ্ঞাসা করছেন, তোমার ক'টা রুটি লাগে, সেই অনুযায়ী রাসমণির ভবতারিনী মন্দিরের খাজাঞ্চিকে বলে যেতে হবে না, নইলে তিনি চোখ বন্ধ করলে সারদাদেবীর যদি খাওয়ার কষ্ট হয়?
আবার এও আছে, “অনেক মানুষ একসাথে দেখলে আমার উদ্দীপন হয়।” আমার মনে হয় ভারতের অধ্যাত্মিক জগতে এ এক নতুন কথা। যেখানে মানুষ গুহায়, জঙ্গলে গিয়ে একা থাকার, নির্জনে থাকার উপায় খুঁজছে, যাতে করে সে তার সাধন আর সাধনার উপলব্ধিকে অসংক্রামিত রাখতে পারে জনসংযোগ এড়িয়ে গিয়ে, ইনি সেখানে মিউজিয়াম, চিড়িয়াখানা, নাটক-থিয়েটার দেখে বেড়াচ্ছেন। আবার বলছেন, এত মানুষ একসঙ্গে দেখলে আমার যে উদ্দীপন হয় গো।
আমরা বলব, কেন তোমার বিরক্ত লাগে না? তোমার ঘৃণা লাগে না?
রামকৃষ্ণদেব হেসে বলছেন, কই লাগে না তো। সবই তো মা। এত মানুষ একসঙ্গে মানে তো বিরাটের সংস্পর্শ। কেন তুমি শোনোনি, গীতায় আছে, “সর্বতঃপাণিপাদং তত্সর্বতোঽক্ষিশিরোমুখম্। / সর্বতঃশ্রুতিমল্লোকে সর্বমাবৃত্য তিষ্ঠতি।।"... সর্বত্র যাঁর পাণিপাদ, সর্বত্র যাঁর চক্ষু, মস্তক এবং মুখ, সর্বত্র যাঁর কর্ণ, তিনি ইহলোক সমস্ত ব্যাপ্ত করে অবস্থান করে আছেন। আমি তো তাঁকে দেখি, স্পষ্ট দেখি। তাঁতে তোমাতে আমাতে কোন ভেদ দেখি না তো!
আমি বলব শুনেছি তো, কিন্তু এমনভাবে কাউকে মিশে যেতে তো দেখিনি। লোকে লোকের মেলা খোঁজে নিজেকে বড় করবে বলে, নেতা কি গুরু হবে বলে, কিন্তু লোকের সমুদ্রে ডুবে যাবে বলে লোক খুঁজতে তো দেখিনি ঠাকুর কাউকে আগে!
রামকৃষ্ণদেবের কথায় আছে, যে ছাদে উঠেছে, সে দেখে ছাদ যা দিয়ে তৈরি সিঁড়িও সেই চুন-সুড়কি দিয়েই তৈরি। ছাদে ওঠার প্রথম সিঁড়ি থেকে ছাদ অবধি রামকৃষ্ণদেব হাত ধরে থাকেন যদি হাতটা বিনা শর্তে বাড়িয়ে দেওয়া যায়।
রামকৃষ্ণদেব প্রচারবিমুখ শুধু ছিলেন না, প্রচারক্ষুব্ধও ছিলেন। কেশব চন্দ্র সেনের সদ্য ছেলের বিয়ে হয়েছে। কয়েকটা উপহার পাঠিয়েছিলেন ঠাকুরের কাছে। তার কয়েকদিন আগে আবার ঠাকুর সম্বন্ধে কাগজেও ছাপিয়ে ছিলেন। ঠাকুর তাঁকে কি মিষ্টি মিষ্টি করে ঝাড়ছেন শুনুন। এ ঝাড় আমাদের সবার জন্য। আজ এই ২০২১ সালে বসে যখন এই লেখাটা লিখছি তখনও মনে হচ্ছে, কি সত্য কথা, কি সোজা দিশা। চোখে পড়ে না কেন?
“আমার নাম কাগজে প্রকাশ করো কেন? বই লিখে, খবরের কাগজে লিখে, কারুকে বড়ো করা যায় না। ভগবান যাকে বড় করেন, বনে থাকলেও তাকে সকলে জানতে পারে। গভীর বনে ফুল ফুটেছে, মৌমাছি কিন্তু সন্ধান করে যায়। অন্য মাছি সন্ধান পায় না। মানুষ কি করবে? মানুষের মুখ চেয়ো না - লোক! পোক! যে মুখে ভাল বলছে, সেই মুখে আবার মন্দ বলবে। আমি মান্যগণ্য হতে চাই না। যেন দীনের দীন, হীনের হীন হয়ে থাকি!”