Skip to main content

উপেন্দ্রনাথ দলাইকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি রীতিমতো বকাঝকা করলেন, একলাখ টাকা জরিমানা করলেন। এই গত বছরের ডিসেম্বর মাসের ঘটনা। তো সেই উপেন্দ্রনাথ দলাই কি করেছিলেন? তিনি সুপ্রিম কোর্টে একটি PIL করেছিলেন, মানে জনস্বার্থে মামলা করেছিলেন যেন শ্রী শ্রী অনুকূল ঠাকুরকে "পরমাত্মা" ঘোষণা করা হয়। এবং ভারতের বাকি সব সম্প্রদায় সেটা যাতে মেনে নেয়।

সুপ্রিম কোর্টের বিচারক বললেন, আপনি আপনার গুরুকে পরমাত্মা ভাবুন, সেটা আপনার বিশ্বাস, সেখানে কারুর কিছু বলার নেই, কিন্তু মশায় সবাইকে ঘাড় ধরে মানাতে চাইছেন কেন? আর তার জন্যে কোর্টের সময়ই বা কেন নষ্ট করছেন? আর আপনার এই মামলায় জনস্বার্থই বা কোথায়? আর আমরা তো এখানে আপনার ভাষণ শোনার জন্যে বসে নেই! আপনি এক লাখ টাকা জরিমানা দেবেন যা একটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে, যাতে করে লোকে এভাবে কোর্টের সময় অপচয় না করে।

এ হল সদ্য ঘটনা। একই ঘটনা রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গেও ঘটেছে। তারা একটা পৃথক ধর্মের দাবী করে কোর্টে কেস করেছিলেন। এবং হেরে গিয়েছিলেন।

কথা হল হিন্দুর ধর্মে তো কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান নেই যারা এসব ঘোষণা করবেন। যেমন মাদার টেরেসা যে সেন্ট ছিলেন সে না হয় সাক্ষীসাবুদ জোগাড় করে বেশ আড়ম্বরপূর্ণভাবে ঘোষণা করা হল। তাদের সে প্রথা আছে। আমাদের নেই। এই যেমন এখন মাইকে শুনলাম যে লোকনাথবাবাকে নিয়ে গান হচ্ছে, সেখানে বলা হচ্ছে তিনি পূর্ণ ভগবান। এখন কথা হচ্ছে চৈতন্যদেব, সাঁইবাবা, রামকৃষ্ণদেব, ওঁকারনাথ ঠাকুর, আনন্দময়ী মা, স্বামীনারায়ণ ইত্যাদি সব সম্প্রদায়ের মানুষই ঘোষণা করেন যে তাদের গুরুদেব ঈশ্বর স্বয়ং। বিবেকানন্দ তো আরো এগিয়ে গিয়ে রামকৃষ্ণদেবকে অবতার বরিষ্ঠায় ঘোষণা করলেন। মানে শ্রেষ্ঠ অবতার। এখন এ কথা বাকিরা মানবে কেন? তাই অন্য সম্প্রদায়ের কাছে কান পাতলে শোনা যায় তারা এই প্রণাম মন্ত্রের ঘোরতর বিরোধিতা করছে।

এখন এর মধ্যে স্টালিনের ছেলে বলে বসলেন সনাতন ধর্ম হল ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়ার মত। একে নিবারণ করা যাবে না, একে উৎখাত না করলে শান্তি নেই। কারণ কি? কারণ সনাতন ধর্ম বৈষম্যকে সমর্থন জানায়।

কথা মিথ্যা নয়। শাস্ত্র ঘাঁটলে তার ভুরি ভুরি উদাহরণ আছে। আর সে সব ঘাঁটতে না চাইলে আম্বেদকরজী প্রমুখের অনেক অনেক অথেনটিক লেখা আছে। সনাতন ধর্মে বৈষম্যের প্রথা তো আছেই। রামচরিতমানস তো হালে লেখা। সেখানেই তুলসীদাস বলছেন যে নারী মাত্রেই জন্ম অপবিত্র। একমাত্র পতিসেবায় সে শুদ্ধ হতে পারে। গীতায় একই সঙ্গে পণ্ডিতে কুকুরে সমদর্শন বলেই, আবার নারী, শুদ্রকে নীচকূলে জাত ঘোষণা করছে। কিন্তু ভগবান সে সবার জন্যেই উদার সে কথাও পাশাপাশি বলা হচ্ছে। তবে ওই কথাটা আগে বলার পর। মজার কথা হচ্ছে এখনও একটা বড় অংশের মানুষ এ দেশে মেয়েদের খুব একটা উন্নত চোখে দেখেন না। সে নানা নিউজের কমেন্টস বক্স, নির্ভয়ার মত তথ্যচিত্র দেখলেই বোঝা যায়। আশেপাশে কান পাতলেই বোঝা যায়।

বিশিষ্ট সমাজবিদ এম এন শ্রীনিবাসের একটা বড় তত্ত্ব ছিল ভারতীয় সমাজের পলিউশন-পিউরিটি থিওরি। অর্থাৎ কথায় কথায় আমাদের সমাজে এই শুদ্ধতা আর অশুদ্ধতার তত্ত্ব। মাসিকচক্র থেকে নাপিত,জমাদার ইত্যাদি সব অশুচি। অশুচির তালিকা বার করতে গেলে পাড়ায় পাড়ায়, পরিবারে পরিবারে এত বৈচিত্র্য পাওয়া যাবে সুপার কম্পিউটারও হয় তো ফেল করবে। শ্রীনিবাসের সেই তত্ত্বে উদ্বুদ্ধ হয়ে ডগলাস একটা বই লিখে ফেলেন যা নিয়ে গোটা বিশ্বে বেশ আলোড়ন হয়, "পিউরিটি অ্যাণ্ড ডেঞ্জার"।

তবে সনাতন ধর্মে বৈষম্য যেমন আছে তেমন তার থেকে বার হবার আন্দোলনের ইতিহাসও আছে। যেমন ভক্তি আন্দোলনের একটা বড় অংশ, ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরোধী ছিল। চৈতন্য মহাপ্রভু তো ছিলেনই, কবীরও যাবতীয় জাতপাতের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন। নানকও। নানক তো মেয়েদের মাসিকচক্রকেও অপবিত্র আখ্যার বিরোধী ছিলেন। এখানে অবশ্যই হরিচাঁদ ঠাকুরের নামও উল্লেখ্য। সেদিন বৈষম্যের বিরুদ্ধে যে লড়াই তিনি করেছিলেন, তার গুরুত্বও সমাজে কম নয়।

তবে শ্রীনিবাস মহাশয়ের সঙ্গে একমত আমি যে, সেই আন্দোলন ও সমাজে তার প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়নি। আধুনিক ভারতের পথিকৃৎ যারা, রামমোহন রায়, যিনি ১৮২৮ সালেই সংস্কৃততে শিক্ষার বিরোধী ছিলেন, চেয়েছিলেন যে ইংরেজিতে শিক্ষা দেওয়া হোক ও আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত করা হোক। তারপর রবীন্দ্রনাথ, গান্ধী, বিবেকানন্দ, রাধাকৃষ্ণণ প্রমুখেরাও লড়াই করেছিলেন একই কারণে। এই বৈষম্যের বিরুদ্ধেই তাদের মত করে।

বৈষম্য তত্ত্ব সত্য। তার বিরোধিতাও সত্য। দুই-ই আছে আজও। আমি কোন রাস্তাটা নেব সেটা আমার উপর। সুপ্রিম কোর্ট যেতে হবে কেন? নিজের বিশ্বাস নিজের কাছে, তার সঙ্গে বিচার মুক্ত, বাস্তবানুগ হলে এত দৌড়াদৌড়ির কি আছে?

আমি আধুনিক কিনা সে আমি কি কি অস্বীকার করছি শুধু তার উপর নির্ভর করে না তো। অনেক ক্ষেত্রেই দেখেছি শুধু বাহবা পাওয়ার জন্য, নিজেকে ব্যতিক্রমী প্রমাণ করার জন্য আজীবন নিজের না মানাকে বিজ্ঞাপন করে যায় কিছু মানুষ। আমার আধুনিকতার পরিচয় অন্যের বিশ্বাস, শ্রদ্ধাকেও মর্যাদা দিয়ে নিজের কাজটুকু শান্তভাবে করে যাওয়া। বিবেকানন্দর একটা কথা বেশ লাগে, অন্ধকার অন্ধকার বলে চীৎকার না করে আলোটা নিয়ে এলেই হয়। তবেই অন্ধকার দূরীভূত হয়। আমার কাউকে চেপে ধরে আধুনিক প্রগতিশীল করতে হবে কেন? আমি নিজে যদি নিজের বিশ্বাসের সঙ্গে খাঁটি থাকি আর নিজের কাজের সঙ্গে সৎ থাকি, তবে কারুর বিশ্বাস-অন্ধবিশ্বাস ইত্যাদি নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় কোথায় আমার!

তবে কি প্রতিবাদ করব না? নিশ্চয়ই করব। তবে সেটা বিজ্ঞাপনের জন্য না, আত্মপ্রচারের জন্য না, যদি কোনো মানুষের উপর অত্যাচার দেখি অন্যায় দেখি, যদি সেটা আমাকে সত্যি সত্যিই ব্যথিত করে, উদ্বিগ্ন করে, রাতের ঘুম কেড়ে নেয়, তবেই যেন প্রতিবাদ করি। তবে সেখানে আমার আত্মপ্রচার থাকবে না। তবে আমার সে লড়াই শৌখিন হবে না। তবে আমি প্রতিবাদের নামে অযথা শোরগোল তুলে ক্যামেরা আর হাততালির দিকে চেয়ে থাকব না, স্বীকৃতির জন্য লালায়িত হব না। সত্য প্রতিষ্ঠা না পাওয়া অবধি লড়ে যাওয়ার দৃঢ় সংকল্প তখন আমার আপনিই আসবে। আর তা পূরণ হলে নিজেকে সবার অলক্ষ্যে সরিয়ে আনার নম্রতাও থাকবে।

 

(এ লেখার প্রসঙ্গে মন্তব্য যদি করতে ইচ্ছা হয়, অনুগ্রহ করে কোনো বহুজন পূজিত ব্যক্তির নামে অশ্রদ্ধাসূচক কিছু লিখবেন না।)