Skip to main content
তবে উপায় কি? উপায় হাজার লক্ষ কোটি। মত যদিও পথ, তবু সে মতের ঘোরে অন্ধকার চারদিক। মতের সাথে মতের লড়াই। বিশ্বাসের সাথে বিশ্বাসের লড়াই। বিশ্বাসের সাথে অবিশ্বাসের লড়াই। বিনাযুদ্ধে কেউ আর সূচ্যাগ্র মেদিনী দেবে না - এমনই হুংকার দশদিকে।
এই লড়াইয়ে অংশীদারি আমি তুমি সে, রাম শ্যাম যদু মধু সব। রাস্তায় দু'জন মানুষের কথায় আড়ি পাতো, শুনবে মত ভাষা পাচ্ছে শ্বাসের জোরে - "আমার মতে তো অমুকের বাড়ি না যাওয়াই ভাল" ... "আর যাই বলুন, অমুকের মত জায়গা হয় না" .... "তবে কি অমুকটা করা তোমার/তার উচিৎ হয়নি"....
সারাদিন চলছে, রাস্তায়, ঘরে, বাজারে, ট্রেনে, বাসে, জাহাজে, প্লেনে, অটোতে, রিকশায়..... এমনকি মনে মনেও... "আমার মতে......"
পার্লামেন্ট বলো, বিদ্যালয় বলো, হাসপাতাল বলো, অফিস কাছারি বলো - সর্বত্র।
মতের সাথে মতের অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম। এটাই ভাল। এটাই হওয়া উচিৎ। তবেই যোগ্যতম মতের উদবর্তন সম্ভব। কোন মত টেকা উচিৎ আর কোন মত নয়, সেটা খণ্ডযুদ্ধ না বাধলে বোঝা যাবে কি করে? তাই এই মতের মতান্তর প্রয়োজন। ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন।
কথা হচ্ছে এই যে - একজন মানুষের কি একটাই মত থাকা উচিৎ? তা না তো কি? অনেক মত থাকা উচিৎ? আমার মনে হয়, হ্যাঁ। সেগুলো আপাত স্ববিরোধী হলেও, তা আখেরে শুভ'র দিকে নিয়ে যায়। কেমন? একটু বলা যাক।
জৈনধর্মে একান্তবাদী ও অনেকান্তবাদী বলে দুটো শব্দ আছে। একান্তবাদী, সেই অন্ধের হস্তীদর্শনের মত; হয় বলে হাতিটা থামের মত, না হয় বলে সরু সুতোর মত ইত্যাদি। হাতি সম্বন্ধে তাদের এইটাই চূড়ান্ত মত।
আর অনেকান্তবাদী দেখেছেন পুরো হাতিটাকেই। তাই তাঁর মতে ওই সব মতগুলোই সত্য। মানে হাতি পায়ের কাছে থামের মত, লেজের কাছে সুতোর মত ইত্যাদি।
তাহলে একজন মানুষের অনেকগুলো মত ক্ষেত্রবিশেষে থাকতেই পারে। আর সেই থাকার অভ্যাস করাটাকেই বর্তমানে নাম দেওয়া হল - ক্রিটিকাল থিংকিং। অর্থাৎ কিনা বিশ্লেষণাত্মক চিন্তন। ভাল কথা। তবে কি এরা সুবিধাবাদী? আপাতদৃষ্টিতে অবশ্য তা মনে হলেও হতে পারে, কারণ সেখানে স্বার্থসিদ্ধির একটা মতলব থাকে। কিন্তু অনেকান্তবাদী যে, সে তার নিজের কাছে সৎ, সে জানে ক্ষেত্রবিশেষে মতের পরিবর্তন না করলে সত্যের অপলাপ হয়। তাই সে কোনো সোজা সরল সিদ্ধান্ত টেনে জীবনটাকে মূর্খের স্বর্গে কাটাতে নারাজ।
এই অবস্থাটাকেই বার্ট্রান্ড রাসেল মহাশয় বলেছিলেন, - সমস্যাটা হল এই দুনিয়ায় বোকারা ভীষণ নিশ্চিত, আর বুদ্ধিমানেরা সংশয়ী। 
সংশয়ী সন্দেহবাতিক অর্থে না, সংশয়ী কারণ সে একটা মতে নোঙর ফেলে বসে থাকতে চায় না। সে সবকিছুকেই নানান দৃষ্টিভঙ্গিতে পরখ করতে চায়।
ধর্মের জগতে এটা একটা বিরাট সমস্যা। এখানে মত শেষ কথা। এখানে মতকেই সত্য নামে চালিয়ে দেওয়ার একটা আদিম প্রবণতা। তুমি ভেবো না। আমি যেটা বলছি মেনে নাও, দেখবে সব ঠিক থাকবে।
এ এক অদ্ভুত দাদাগিরি। অনুভূতি নেই, আস্ফালন আছে। সত্য নেই, সত্যের মুখোশ আছে। প্রাণ নেই, মুক্তি আছে। এ তো মহামুশকিল। সারা বিশ্বজুড়ে একটা ত্রাস হয়ে উঠছে এই মতের বোমা। যদি তুমি বাঁধতে পারো এ বোমা তবে তুমি বেঁচে গেলে, না বাঁধবে তো এই বোমা দিয়েই তোমার পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটিয়ে ছাড়ব। উফ্, কি সমস্যা। স্বামী রঙ্গনাথানন্দজী (রামকৃষ্ণ মিশনের ভূতপূর্ব প্রেসিডেন্ট) একটা দামী কথা বলতেন। একটা বড় বিজ্ঞানের সভা করো। দেখো সভা শেষে সবাই হাসিমুখে বেরিয়ে আসছে, যথেষ্ট তর্কাতর্কির পরও। কিন্তু একটা ভিন্ন ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের নিয়ে একটা সভা বসাও, দেখবে সব হাত, পা, মাথা ভেঙে বেরোচ্ছে।
এই হল বিপদ। এখানে উদারতা হল অস্তিত্বের সংকট। ঠিক যেমন রাজনীতিতেও। উদারতা দেখিও না বাপু, তবে প্রতিপক্ষ ভাববে তোমার আত্মবিশ্বাস কম, অথবা তোমার মতে কিছু একটা গোলমাল আছে।
তবে উপায়? রাজনীতিতে বলতে পারি না। ধর্মনীতিতে স্বামীজির বিখ্যাত উক্তিই মনে আসে, যতগুলো মানুষ ততগুলো ধর্মমত হওয়া উচিৎ। বেশ কথা। তাঁর গুরুরও একই মত। এত দলাদলি কি দরকার বাপু? ধোপাঘরের গামলা। নানান রঙ। যে রঙে চাও ছোপো। একঘেয়ে কেন হবে? আহা কি কথা! কবে যে এর আরো বিস্তার হবে মহাকালই জানেন!