'হিকিকোমরি' নামটা শোনা? কারোর কারোর শোনা শোনা লাগতে পারে। একটা বাংলা সংবাদপত্রে খবরটা বেরিয়েছিল।
স্থান জাপান। সেখানে এক প্রকার মানসিক অস্বাভাবিকতা (বিশেষ করে যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে) দেখা যাচ্ছে। তাঁরা নিজেদের গৃহবন্দী করে রাখছেন মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। সারাটা সকাল ঘুমাচ্ছেন। রাতে ইন্টারনেটে জাগ্রত থাকছেন। সমস্যা গভীর। চিকিৎসকেরা দিশাহীন। সেই স্বেচ্ছা নির্বাসনের সময় কাল কারোর কারোর ক্ষেত্রে নাকি তিরিশ বছরেরও বেশি!
ঘটনাটা ভাবালো। মানুষ সৃষ্টিশীল কর্মে, কি আত্ম-উপলব্ধি হেতু স্বেচ্ছা নির্বাসন নিয়েছেন - এমন উদাহরণ ইতিহাসে বহু আছে। শুনেছি ডারউইন সাহেব তাঁর 'প্রাকৃতিক নির্বাচনবাদ তত্ত্ব' লেখার সময় বহু বছর বাড়ির বাইরে পা রাখনেনি। এরকম বহু তথ্য সম্বলিত লেখা বার্ট্রান্ড রাসেলের, 'Conquest of Happiness' নামক অসামান্য বইতে, 'Boredom' অধ্যায়ে আছে। কিন্তু এ যে বাস্তব জগতকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করার তাগিদে স্বেচ্ছা নির্বাসন, এটা খানিক চিন্তার বিষয় বইকি!
মনোবিজ্ঞানীরা যতদূর বিষয়টা নিয়ে ভেবেছেন, তাতে তাঁদের একটাই কথা বারবার মাথায় আসছে - অতিরিক্ত চাপ -স্কুলে, কলেজে, কর্মক্ষেত্রে।
কথাটা ঠিক। না হলে একজন শক্ত সামর্থ্য মানুষ, এমন সুন্দর পৃথিবী, জীবন ছেড়ে অন্ধকারের আশ্রয়ে বাঁচতে চাইবে কেন?
চাইবে নাই বা কেন? জীবন তাকে ছোটবেলা থেকে কি শিক্ষা দিচ্ছে? না, কিছুটা ভুল হল। জীবন না, তার চারপাশ। সে একজন আর সারা বিশ্ব আরেকজন। তোমার সাথে 'সবার' লড়াই। কি অসম ব্যবস্থা! সে শুধুই প্রতিদ্বন্দ্বী হতে এসেছে। ঘরে-বাইরে তার একটাই মন্ত্র, আমি! লড়ে যাও। ছুটে যাও। ছিনিয়ে নাও। যতটা পারো ওঠো। কে পড়ল, কে মরল তাকিয়ো না। যত জমাবে, তত সার্থক। যত কিনবার ক্ষমতা, তত ক্ষমতার অধিকারী তুমি। তোমার জীবন সার্থক।
অথচ সে চারিদিকে তাকিয়ে কি দেখছে? দেখছে চারদিকে শুধু এই সার্থকতার রূপকথা নেই। সেখানে ব্যর্থতা আছে, বিশ্বাসঘাতকতা আছে, হতাশা আছে, বিষাদ আছে, অকাল মৃত্যু আছে, দুরারোগ্য ব্যাধি আছে, আরো আরো কত বিরুদ্ধ শক্তি আছে!
তার নিজের মধ্যেও দ্বন্দ্ব আছে, হৃদয় আছে, আবেগ আছে, অনিচ্ছা আছে, ভয় আছে, আরো আরো কত বিরুদ্ধ শক্তি তার মধ্যেও তো আছে।
- আচ্ছা এগুলো কি সত্যিই বিরুদ্ধ শক্তি?
বিরুদ্ধ শক্তিই বটে। তবে তা জীবনের হিসাবে না। আমাদের তৈরী স্বপ্নময় জীবনের বিরুদ্ধে। কারণ আমাকে তো জীবনের অর্ধপাঠ দেওয়া হয়েছে। জীবন মানে ভোগ, সফলতা, স্বাস্থ্য, প্রতিযোগিতা ইত্যাদি।
কিন্তু জীবন মানে তো শুধুই Positive Thinking না। তার সাথে অনেক কিছু Negative-ও তো আছে। হ্যাঁ আছে। সেগুলোকে জোর করে Positive বানানোর তো কোনো কারণ দেখি না। সে বড় অবাস্তব শিক্ষা। Negative কে Negative ভাবেই স্বীকার করতে হবে। মানতে হবে জীবনটা একটা অভিজ্ঞতার যাত্রা। তাতে জেতা-হারা, সুখ-দুঃখ, সুসময়-দুঃসময়, বন্ধু-শত্রু, উদ্যম-হতাশা ইত্যাদি জোড় বেঁধে বেঁধে আসবেই। যে স্নায়ু আমার সুখ নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে, সেই স্নায়ুই আমার দুঃখকে বহন করারও ক্ষমতা রাখে। আমার চলার সাথে থামা, চাওয়ার সাথে দেওয়া, ভোগের সাথে ত্যাগের যদি সামঞ্জস্য না থাকে তো তরী একদিকে কাত হয়ে নদীতে ডুববেই, এ আর কি এমন আশ্চর্য কথা?
অর্জুন যখন কুরুক্ষেত্র দেখে শোকে ভয়ে একেবারে যা তা অবস্থায়, তখন কৃষ্ণ তাকে কি মোক্ষম কথাটাই না শোনালেন। বললেন, ভাই রে, সুখ-দুঃখ, লাভ-অলাভ, জয়-পরাজয় - এ সবকে সমান বোধ করে যুদ্ধে নামো দেখি বাবা।
এই হল পূর্ণ জীবন পাঠ। দু'দিক সামলে যদি চলতে পারো তো চলো। না হলে 'বিদ্যে বোঝাই বাবু মশাই' হয়ে বাড়ি বসে থাকো। শখের বোটে আর চড়ে কাজ নেই। বাড়ির সুইমিং পুল রইল। তাতে ঢেউ নেই, ঝড় নেই, কুমীর নেই, হাঙর নেই। প্রাণ ভরে সাঁতার কাটো, জলকেলি করো, যা খুশী করো। শুধু মনে রেখো, ওতে জীবনও নেই।
জীবনের এক হাত মরণের হাতে গোঁজা। ছাড়াতে যেও না। খেলে যাও। তখন বুঝবে, এখানে কেউ জিততে আসে না, খেলতে আসে। হারা জেতাটা by product বলতে পারো। এই হল জীবনের পূর্ণ শিক্ষা।
"মরণকে তুই পর করেছিস ভাই, জীবন যে তোর তুচ্ছ হল তাই"