সম্পর্কের একটা যত্ন হয়। তাতে 'ধরে রাখা' আর 'ছেড়ে রাখা'র হিসাবটা খুব সহজ হিসাব না। যখন কোনো একটা দিকে ঝোঁক বেশি হয় তখনই সম্পর্কটা ভারসাম্যহীন হতে শুরু করে।
যদি 'ধরে রাখা'র জোরটা খুব বেশি হয় তখন সে সম্পর্কটা ক্রমশ কারাগারের রুপ নেয়। "এত ফোন কেন?"... "এত কৌতুহলের কি আছে?"..."আরে আমার কি ব্যক্তিগত জীবন বলে কিছু থাকতে নেই!"....ইত্যাদি ক্ষোভ, অসন্তোষ বাড়তে শুরু করে, যদিও অনেক সময় তার হয়তো কোনো বাহ্যিক প্রকাশ নাও থাকতে পারে। সেটা আরো ক্ষতিকারক।
তখন আরেকজনের মনে হয়, "আমি এত যত্ন করি, এত খেয়াল রাখি তবু তার এত মনক্ষুণ্ণতা কিসের? কেন সম্পর্কটা এরকম ছাড়াছাড়া হয়ে পড়ছে? কথায় কথায়, ছোটখাটো ব্যাপারেও এত বিরক্তি কেন?"
ফলস্বরুপ, দু'জনের মধ্যে যে স্বাভাবিক মানসিক আদান প্রদানের পথ, যেটা বেঁচে থাকার আত্মিক অক্সিজেন, সেটা বন্ধ হতে শুরু করে।
আর এর উল্টোটা যখন ঘটে। যখন 'ছেড়ে রাখা'র প্রবণতাটার মাত্রা বেশির দিকে হয়ে পড়ে। তখন একজন নিজেকে কম গুরুত্বপূর্ণ বোধ করতে থাকে। হীনমান্যতায় ভোগা শুরু হয়। কারণ সংসারে নিজেকে নিজের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বানিয়ে রাখবে, বা সম্পূর্ণ আত্মমগ্ন থাকবে, এমন মানুষ প্রশংসনীয় হলেও সংখ্যায় যে কোনো সমাজেই তাঁরা বিরল। সাধারণ মানুষের কাছে আমার গুরুত্ব তোমার ভালবাসায়। আর সে ভালবাসার প্রকাশ হল আমার প্রতি তোমার মনোযোগে। এই সহজ চিরকালীন আটপৌরে হিসেব।
তাই সে মনোযোগের যখন বাহ্যিক কোনো প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায় না, কোনো আবেগকেই যখন কথায়-কাজে রুপান্তরিত হতে দেখা যায় না, তখন সম্পর্কের মধ্যে একটা শীতল হিমবাহ তৈরী হতে থাকে। কোনো এক সময়ে দুজনেই আর সেটা অতিক্রম করে একে অপরকে স্পর্শ করতে পারে না, প্রাণান্তকরভাবে চাইলেও। দীর্ঘদিনের মানসিক অপ্রকাশ তাদের নিজেদের মধ্যে নিজেদের নিয়ে একটা অস্বচ্ছ মাতাজাল তৈরী করে নেয়। একজনের আচরণের কারণ আরেকজন তার কল্পনা অনুযায়ী করতে শুরু করে। "হয়তো আমাকে নিয়ে ওর কোনো অসুবিধা হচ্ছে"...."হয়তো ওর আর কাউকে ভাল লাগতে শুরু করেছে"... "হয়তো ওর কোনো মানসিক সমস্যা আছে".....
এধরণের হাজার জল্পনা-কল্পনা ক্রমশ সম্পর্কটাকে খাদের ধারে এনে দাঁড় করায়, সত্যিটাকে আড়াল করে। সত্যিটা সামনে এলেও তাকে স্বীকার করার মত মানসিক স্বচ্ছ দৃষ্টি ততদিনে তারা দুজনেই হারিয়ে ফেলেছে।
তাই শুরুতে বলছিলাম কোনো সম্পর্কের ভারসাম্য রাখাটা খুব সহজ একটা কাজ না। একজনের মন আরেকজনের থেকে অসংবেদনশীল হতেই পারে শুধু না, হয়েই থাকে। একজনের ত্যাগ আরেকজনের থেকে বেশি হয়েই থাকে। তবে তারও একটা সীমা আছে। যে ভাগটা সব সময়েই আমাদের মত পিতৃতান্ত্রিক সমাজে মেয়েদের ঘাড়েই চাপানোর চেষ্টা চালানো হয়েছে, মেয়েদের হাজার মহত্ত্ব বর্ণনা করে। সে অন্য আলোচনা।
সজাগ দৃষ্টি, স্বচ্ছ কথাবার্তা আর পারস্পরিক শ্রদ্ধা যে কোনো সম্পর্ককেই খাদের ধার থেকে বাঁচাতে পারে বলে বিশ্বাস করি। হয়তো সে সম্পর্ক আগের ধারায় বইবে না, তবে সে তার নতুন ধারা বানিয়ে নিতেই পারে। সম্পুর্ণ নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার থেকে যা শতগুণে ভাল।