"আমার মনে হয় ওকে বিয়ে করলে ও আমাকে ভালো রাখবে…."
আমার কানে লেগেছিল শুনে কথাটা। প্রথম কথা আমি কুকুর বা গাভী নই যে আমাকে কাউকে ভালো রাখতে হবে। সময়ে সময়ে মাংসভাত মেখে মুখের সামনে দেবে কি খড়বিচালি কেটে দেবে। আমি নিজে যদি নিজেকে ভালো রাখতে না জানি তবে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর কারোর সাধ্যি নেই আমায় ভালো রাখে। আর আমাকে কেউ ভালো রাখবে এই প্রত্যাশায় একজনকে পরিবারে আনা আর একটা ওয়াশিংমেশিন কি ফ্রিজ কিনে ঘরে আনার মধ্যে কোনো পার্থক্য আছে বলে আমার মনে হয় না।
আমেরিকার একটা প্রথম সারির দৈনিকে খবর বেরোলো যে পুরুষেরা নাকি প্রচণ্ড একাকীত্বের শিকার হচ্ছে। তাদের জীবনে তাদের স্ত্রী বা বান্ধবী ছাড়া আর কেউ থাকছে না। তারা সমাজ জীবন থেকে নিজেকে এমন বিচ্ছিন্ন করে ফেলছেন যে স্ত্রী আপিস থেকে দেরি করে ফিরলেও একাকীত্বের যন্ত্রণায় নাকি বার পাঁচেক ফোন করে ফেলছেন অস্থির হয়ে। স্ত্রী নাকি মা, বোন, বান্ধবী ইত্যাদির ভূমিকায় এমন দড়। সে নাকি স্বামীকে হাতে ধরে পার্কে নিয়ে যাওয়া থেকে গভীর আবেগে আদরের তুঙ্গ শিখরে নিয়ে যাচ্ছে। ফল কি হচ্ছে? পুরুষ মানুষ নাকি একা হয়ে যাচ্ছে!
এখন স্ত্রী মা-বোন-বন্ধু সব হোন। হতেই পারেন। এ গল্প শুনতে আমাকে তো মার্কিন মুলুকে যেতে হয়নি, এখানেই শুনে শুনে চুলে পাক ধরে গেল। কিন্তু সমস্যা হল এর পরেও এত একাকীত্ব কেন বাপু? একাকীত্বকে কোমর্বিডিটির সঙ্গে তুলনা করা হয়। একাকীত্বের যন্ত্রণায় মানদিক অবসাদ, তার থেকে হৃৎপিণ্ডের ব্যামো, তার থেকে আত্মহত্যা করার প্রবণতা ক্রমে ক্রমেই বেড়ে চলে।
আমার মনে হয় আসলে এ সবই ভুল ব্যাখ্যা। অতিকথন। কাগজগুলো বিক্রি করার ধান্দা। বলি একাকীত্ব মানুষের চয়েস না অবস্থা? আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি অনেক ক্ষেত্রেই চয়েস। এই যেমন আজ একুশে জুলাই, কাতারে কাতারে লোক যাচ্ছে কলকাতায়। আমি রাজনীতির কথা আনছি না। কিন্তু বেশ কিছু পোস্ট দেখলাম, তাদের ধারণা তারা সবাই নাকি ডিমভাত খেতেই যাচ্ছে। সবাই বিশুদ্ধ রাজনৈতিক কারণে আসছে না যে এ সত্য। কিন্তু এত এত সহস্র মানুষের ঢলকে যারা তুড়ি মেরে অপমান করে দিতে পারে, তারা নিজেদের মনের মধ্যে যে অতিশুদ্ধতার বেড়াজাল তৈরি করেছে, সে কার দোষে? কোনো কিছুকেই একপেশে করে দেখা অপরিণত মানসিকতার লক্ষ্মণ। বিদ্বেষ অবশ্য সব সময়েই একপেশে। আর সেই বিদ্বেষ তাকে এত লক্ষ মানুষ থেকে মুহূর্তে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে দিল। একাকীত্বের পিছনে বড় একটা মানসিকতা এই বিদ্বেষ। আমি উন্নত, আমি সঠিক, আমি নির্ভুল, আমি নীতিবান। ওরা সব আমার বিপরীত। অগত্যা আমি কার সঙ্গে মিশব? কার সঙ্গে একাত্ম অনুভব করব? আমার যোগ্য কে আছে? কে আমায় বোঝে? ইত্যাদি ইত্যাদি।
যা হোক, এখন কথা হচ্ছে পুরুষের তবে একাকীত্ব কাটানোর নিদান কি? আমিও ঘরে বাইরে দেখেছি, একজন মহিলা এমনকি পরিণত বয়সেও স্বামীকে হারানোর পর নিজেকে নানা কাজে, নানাভাবে ব্যস্ত রাখেন। কিন্তু একজন পুরুষ একটা বয়সের পর স্ত্রীকে হারালে সম্পূর্ণ নিজেকে গুটিয়ে নেন। যেন অস্তিত্বটুকুই নেই আর নিজের। এ কি ভালোবাসা? না, আপাত দৃষ্টিতে মনে হলেও এ ভালোবাসা নয়। এ মানসিক পঙ্গুত্ব। ভালোবাসা মানুষকে পঙ্গু করে না। অযৌক্তিক আসক্তি মানুষকে পঙ্গু করে তোলে। আনরিয়েলিস্টিক অ্যাটাচমেন্ট, ভীষণ ক্ষতিকর। অ্যাটাচমেন্ট মানে তো আর ভালোবাসা নয়, অ্যাটাচমেন্ট মানে অ্যাটাচমেন্টই।
আমার আসক্তি আর আমি। এই দুইজনের মধ্যে কে কারাগার, কে বন্দী? আসক্তি কারাগার। আমি বন্দী। আমারই তৈরি আসক্তি। তাই আমি কেটে বেরোতে পারছি না। চাইছি না। ভালোবাসতে যে শক্তি দরকার, যে সহনশীলতা দরকার তা আমার নেই। আমার আসক্তি আছে। আমার আত্মসম্মান নেই। আমার আসক্তি আছে। আমার নিজেকে নিয়ে কোনো স্বাধীন স্বপ্ন নেই, কোনো স্বনির্ভর দায়িত্ব নেই। আমার আসক্তি আছে। আমার অভিমান আছে। আমার মান আছে। কিন্তু আমার স্বমত, বা স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেই। কারণ আমার আসক্তি আছে।
আসক্তি থেকে জন্মায় বায়াসনেস। বা পক্ষপাতদুষ্ট বুদ্ধিবিচার। পক্ষপাতদুষ্ট বিচার থেকে জন্মায় অবাস্তব, অসত্য দৃষ্টিভঙ্গী। সেই বিকৃত দৃষ্টিভঙ্গী থেকে জন্মায় কারাগারের শিকল। যে শিকল মায়াময়। কিন্তু সেই বিকারগ্রস্ত দৃষ্টিতে তা-ই সত্য। ফল, একাকীত্ব। যন্ত্রণা।
যদি একাকীত্ব থেকে বেরোতে হয়, তবে সব আসক্তিকে আগে দূর করতে হবে। সে যে ছদ্মবেশেই আসুক। ভালোবাসা, রাজনীতি, ধর্ম, ঈশ্বর, গুরু, আদর্শ, মতামত ইত্যাদি যা কিছুই তার আধার হোক না কেন, আসক্তি মানেই আসক্তি। আদতে ভীষণ ক্ষতিকর। জীবনে স্রোত থাকুক, আসক্তির নোঙর ফেলে কি লাভ? কোনো মানুষের সাথে, কি কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে, কি আদর্শের সাথে, কি কোনো ধর্মের সাথে, কি কোনো মতের সাথে নিজেকে আসক্ত রাখব কেন? তবে সত্য তো আমার নাগালের বাইরেই থেকে যাবে চিরটাকাল! আর সত্য যেখানে নেই, সেখানে গতি নেই, স্রোত নেই। যেখানে আসক্তি নেই। সেখানে স্রোত আছে। আর স্রোতে যে ভেসে চলেছে তার পক্ষে একাকীত্বে ভোগার অবসর কোথায়? সে আজ এই কূলে, তো কাল সেই কূলে। সে তো পথিক। পথিক কোনোদিন একা হয় না। কারণ সত্যের পথ অনন্ত। ফুরায় না যে!