Skip to main content

শিরডি'র সাঁইবাবাকে নিয়ে লেখা 'সাঁই সৎচরিত্র' বইতে একটা ঘটনার বর্ণনা আছে। আমি গল্পটার অলৌকিক দিকটার দিকে মন না দিয়ে ঘটনাটার কথা বলি---

 

ঈশোপনিষদের প্রথম শ্লোকে আছেঃ

ঈশা বাস্যমিদং সর্বং যৎ কিঞ্চ জগৎ্যাং জগৎ।

তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা মা গৃধঃ কস্য স্বিদ্ধনম্‌।।

অর্থাৎ, সমস্ত জগৎকে ঈশ্বর দ্বারা আচ্ছাদিত বা ঈশ্বরময় দেখবে, ত্যাগের দ্বারা ভোগ করবে, এবং কারোর ধনে লোভ করবে না।

 

ব্রাহ্মধর্ম স্থাপনার পিছনেও এই শ্লোকটির একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। কিন্তু সে কথা আপাতত থাক।

ঘটনায় লেখা হচ্ছে সাঁইকে এই শ্লোকটির অর্থ একজন জিজ্ঞাসা করেন। সাঁই স্পষ্ট উত্তর বলেন না, তবে প্রশ্নকর্তা একটা বিশেষ ঘটনার মাধ্যমে এই শ্লোকের অর্থ বুঝে যাবেন সেটা উল্লেখ করেন।

সেই প্রশ্নকর্তা কয়েকদিন পর একজন ধনী বন্ধুর পরিবারে অতিথি হয়ে এসেছেন। কয়েকদিন থাকবেন। সেই পরিবারে একজন অল্পবয়েসী মেয়ে বাড়ির কাজের জন্য আসত। তার সদাপ্রসন্ন ব্যবহারে ইনি ভীষণ খুশী হন। সেই মেয়েটার ছেঁড়া শাড়ি দেখে একদিন বাজার থেকে বেশ ভালো একটা শাড়ি উপহার দেন। মেয়েটা ভীষণ খুশী হয় উপহার পেয়ে। পরেরদিন সেই নতুন শাড়ি পরে সে কাজে আসে। বেশ উচ্ছ্বসিত সে। অতিথিও মেয়েটার আনন্দ দেখে খুশী হন। কিন্তু দু'দিন পর খেয়াল করেন মেয়েটা আবার সেই পুরোনো ছেঁড়া শাড়ি পরে কাজে এসেছে। কিন্তু তার জন্যে মুখে কোনো মলিনতা বা অপ্রসন্নতা নেই। সেইরকম গুনগুন করে গাইতে গাইতে বাসন মাজছে, ঘর পরিষ্কার করছে। অতিথি কিছু বিস্ময়েই তাকে জিজ্ঞাসা করেন, তুমি নতুন শাড়িটা পরলে না আজ?

মেয়েটা বলে, সে শাড়িটা বাক্সে তুলে রেখেছি, পরে পরব, আপাতত এই শাড়িটা তো আছে আমার, এতেই হয়ে যাচ্ছে।

অতিথি তার নির্লোভ প্রসন্নতায় অবাক হয়ে যান ও সঙ্গে সঙ্গে উপনিষদের সেই শ্লোকটার কথা মনে পড়ে যায়। ত্যাগের দ্বারা ভোগ ও লোভ না করে সন্তুষ্ট থাকার কথাটাও বুঝতে পারেন।

হঠাৎ এই গল্পটা মনে পড়ে গেল আজ। চলতে ফিরতে এমন কিছু কিছু মানুষের সঙ্গে পরিচয় তো হয়েই যায়, তাই না? কি অল্পে তুষ্ট থাকার ক্ষমতা তাদের! আশ্চর্য লাগে। নিজের মনের মধ্যে সযত্নে রাখা আগামী ইচ্ছা-বাসনা-সাধের লিস্টের দিকে তাকালে নিজেকে কি ক্ষুদ্র অনুভব হয়। ইংরাজিতে 'স্যাটিসফেকশন' আর 'কন্টেন্টমেন্ট' বলে দুটো শব্দ আছে। বাংলায় তো দুটোকেই বলে 'সন্তুষ্টি'। কিন্তু অর্থে তো দুটোর মধ্যে বিস্তর ফারাক। 'স্যাটিসফেকশান' মানুষকে বড় অসংবেদনশীল, আত্মকেন্দ্রিক করে তোলে দেখেছি। কিন্তু 'কন্টেন্টমেন্ট' তা করে কি? কন্টেন্টমেন্ট কেউ অর্জন করতে পারে না... এর কোনো আলাদা প্রয়াস হয় না, এ এক অদ্ভুত বোধ। অন্তর থেকে জন্মায়। নির্বোধ মানুষ স্যাটিসফায়েড হতে পারে, কিন্তু কন্টেন্ডেড থাকার জন্য একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অন্তর্দৃষ্টি না থাকলেই নয়।

এইরকম সন্তুষ্ট, শান্ত মানুষেরা আছে বলেই সংসারে জিরোবার জায়গা পাওয়া যায় কিছু। যাদের পাশে বসলে মনের মধ্যে শান্তির শীতল বাতাস বয়ে যায়। একেই হয় তো সাধুসঙ্গ বলে, জানি না। আজকাল তো সাধুরাও তুষ্ট নয়, বড় ক্ষুব্ধ, রাগী বেশিরভাগই। কিন্তু সংসারে গেরুয়াহীন এমন কিছু কিছু মানু্ষের সংস্পর্শ তো অবশ্যই পেয়েছি। যারা কেবল জমায় না, যারা হাঁটে শুধু না, আরো কিছু মানুষের জন্য রাস্তা বানিয়ে হাঁটে।

মুরারিবাপু'র মুখে একটা গল্প শুনেছিলাম, যেটা বলেই এ প্রসঙ্গ শেষ করি। একটা রেস্টুরেণ্টে একটা সিংহ আর একটা শেয়াল বসেছে পাশাপাশি। ওয়েটার এসে খাওয়ারের অর্ডার নিচ্ছে। শেয়াল খাওয়ারের অর্ডার দিয়েই যাচ্ছে, দিয়েই যাচ্ছে। পুরো অর্ডার নিয়ে ওয়েটার সিংহের দিকে ইশারা করে শেয়ালকে বলল, চাচাজী কুছ নেহি লেঙ্গে?

তখন শেয়াল একটু হেসে বলল, চাচাজীকো ভুখ নেহি হ্যায়, ইসিলিয়ে তো ম্যায় ইঁহা পর ব্যায়ঠা হুঁ না!

সেই হল কথা। এমন চিত্তে শান্ত, তুষ্ট, আনন্দিত মানুষ হারিয়ে গেলে মানুষ জুড়াবে কোথায়? দিশাই বা পাবে কোথায়? সবাই যদি দৌড়াবে কাউকে তো স্থির হয়ে আম্পেয়ারিং বা রেফারিং-এর কাজটা করতে হবে। সেই মানুষগুলোই আমাদের শান্তির আলো, আমাদের ভোরের আগমনী, আমাদের সন্ধ্যের শাঁখের আওয়াজ। বাকি তো শুধু কোলাহল আর ধুলো।